It is now

Tuesday, September 3, 2013

হযরত ইউসুফ (আঃ) ও জুলেখা

হযরত ইউসুফ (আঃ) এর পিতা ছিলেন হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম। হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর স্ত্রীর পক্ষ হতে বার জন ছেলে ছিল। ইউসুফ (আঃ) ও তার ছোট ভাই বিনইয়ামীন ছিলেন একই মায়ের ওরসের। ছোটবেলাতেই হযরত ইউসুফ (আঃ), ইয়াকুব (আঃ) এর উপর নবুয়তের নূরের উজ্জ্বল আভা দেখতে পেয়েছিলেন। আবার ইউসুফ (আঃ) ও বিনইয়ামীনের মাতা তাদেরকে শিশু অবস্থায় রেখেই মারা যান। তাই ইয়াকুব (আঃ) এদের দুইভাইকে অন্যদের চেয়ে একটু বেশী আদর করতেন। তাই বড় ভাইয়েরা তাদের দুজনকেই হিংসা করতো।


ইউসুফ (আঃ) এর শিশুকাল ঃ

ছোটবেলায় ইউসুফ (আঃ) চমৎকার একটি স্বপ্ন দেখলেন। তিনি দেখলেন, এগারোটি নক্ষত্র ও চন্দ্র-সূর্ষ ইউসুফ (আঃ) এর সম্মুখে নত হয়ে তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করছেন। স্বপ্ন শুনে ইয়াকুব (আঃ) ইউসুফ (আঃ) কে অনেক দোয়া করলেন এবং স্বপ্নটি তার সৎ ভাইদের কাছে প্রকাশ করতে বারণ করলেন। ইয়াকুব (আঃ) বুঝতে পারলেন, একদিন ইউসুফ (আঃ) আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত প্রাপ্ত হবেন। গভীর জ্ঞানী হবেন ও অত্যন্ত নিখুত ভাবে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে পারবেন।

ইউসুফ (আঃ) এর ভাইয়েরা তাকে মেরে ফেলার কিংবা দূরে কোথাও ফেলে আসার ষড়যন্ত্র করতে লাগলো। একদিন সকালে ভাইয়েরা পিতার কাছ হতে অনুমতি নিয়ে ইউসুফ (আঃ) কে ঘুরতে নিয়ে গেল। এবং তাকে অন্ধকার কূপের মাঝে ফেলে দিল। তারপর ইউসুফ (আঃ) এর জামায় রক্ত মেখে, সন্ধার পর ভাইয়েরা কাঁদতে কাঁদতে পিতাকে এসে বললো যে, তারা দৌড় প্রতিযোগীতা করছিল, এর মাঝে বাঘ এসে ইউসুফ (আঃ) কে খেয়ে ফেলেছে। জামাটি বাঘে খাওয়া মানুষের জামার মতো ছিঁড়া-ফাটা ছিল না। তাই ইয়াকুব (আঃ) বুঝতে পারলেন যে, ছেলেরা মিথ্যা বলছে। ইউসুফ (আঃ) কে বাঘে খায় নি। ইয়াকুব (আঃ) ইউসুফ (আঃ) কে আল্লাহর হাওলা করে ধৈর্য্য ধরে রইলেন।

এদিকে একদল সওদাগর ঐ পথ দিয়ে যাবার সময় কূপ থেকে পানি ওঠাবার জন্য কূপের ভেতরে ডোল ফেললো। আর আল্লাহর অশেষ রহমতে ইউসুফ (আঃ) ঐ ডোল ধরেই কূপ হতে উপরে উঠে এলেন এবং প্রানে বেঁচে গেলেন। সওদাগর দল তাকে লুকিয়ে রাখলো। তারপর মিসরে পৌঁছে কিছু রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে ইউসুফ (আঃ) কে মিসরের মন্ত্রী আযীযের কাছে বিক্রি করে দিলো।

মিসরের উজিরে আযমের গৃহে ইউসূফ (আঃ):
 
মিসরের উজিরে আযম তথা  শাসনকর্তা আযীয নি:সন্তান ছিলেন। তাই তিনি ইউসুফ (আঃ) কে বিশেষ সুনজরে রক্ষনাবেক্ষন করার জন্য তাঁর স্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেন। হয়তো ভবিষ্যতে তিনি তাদের কোন উপকারে আসতে পারেন, সে আশায়। ইউসুফ (আঃ) ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন ও আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি যখন যুবক হয়ে উঠলেন, তখন উজিরে আযমের ছোট স্ত্রী যুলেখা তাকে পছন্দ করে ফেললেন। একদিন যুলেখা ইউসুফ (আঃ) কে প্রেমের আহ্বান জানালেন। এতে ইউসুফ (আঃ) ভয় পেলেন ও আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করলেন। ইউসুফ (আঃ) কে আল্লাহ তা’য়ালা পাপ হতে রক্ষা করলেন। কিন্তু সারা শহরে ইউসুফ (আঃ) ও যুলেখাকে নিয়ে কানাঘুষা চলতে লাগলো। এই পরিস্থিতিতে যুলেখা শহরের কিছু মহিলাকে আমন্ত্রন করলেন ও ছুরি দিয়ে কেটে খাবার মত খাদ্য ও ফলের ব্যবস্থা করলেন। তারা সবাই নিমন্ত্রনে এলে যুলেখা ইউসুফ (আঃ) কে তাদের সম্মুখে ডাকলেন।

ইউসুফ (আঃ) সম্মুখে এলে সব অতিথিরা তাকে দেখে তার রুপ-সৌন্দর্ষে থ’ হয়ে গেল। নিমন্ত্রিত নারীরাও ইউসুফ (আঃ) কে পরামর্শ দিলেন, আজীজের স্ত্রী যুলেখার প্রেমে সারা দেবার জন্য। ইউসুফ (আঃ) খুবই বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেন এবং আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালেন, “হে আল্লাহ এর চেয়ে আমার কাছে জেলখানা বা কারাগারই উত্তম। তুমি আমাকে তাদের ফন্দি হতে বাঁচিয়ে রাখো। যদি তুমি না বাঁচাও, তবে আমি তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়তে পারি এবং অজ্ঞানদের দলভুক্ত হয়ে যেতে পারি।” আল্লাহ তা’য়ালা ইউসুফ (আঃ) এর দোয়া কবুল করলেন এবং পরবর্তীতে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হলো।

কারাগারে ইউসুফ (আঃ):

ইউসুফ (আঃ) কারাগারে তওহীদের প্রচার করতে থাকে। তার জ্ঞান-গুণ এবং নূরানী চেহারায় সবাই তাঁর প্রতি ভীষন ভাবে আকৃষ্ট হতো। তিনি কারাগারবাসীদের বোঝাতেন যে, ‘আমি আমার পূর্ব পূরুষ ইব্রাহীম (আঃ), ইসহাক (আঃ) ও ইয়াকুব (আঃ) এর মতবাদের অনুসারী।’ আল্লাহ এক, অদ্ধিতীয়, আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর উপাসনা করা মহা অন্যায়। তোমরা সবাই এক আল্লাহর বন্দেগী করবে।

ইউসুফ (আঃ) যখন কারাগারে ছিলেন, তখন সেখানে রাজার খাবারে বিষ মেশানোর অপরাধে দুই কয়েদী বন্দী ছিলেন। একদা দু’জনেই স্বপ্ন দেখলেন। এরা ইউসুফ (আঃ) এর কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। একজন দেখলেন যে, তিনি আঙ্গুরের রস বের করছেন। অপরজন দেখলেন, তিনি যেন মাথায় রুটির বোঝা রেখেছেন আর কিছু পাখী তা খাচ্ছে।

 ইউসুফ (আঃ) স্বপ্নের ব্যাখ্যায় বললেন, যে দেখেছেন আঙ্গুরের রস বের করছে, বিচারে সে নির্দোষ সাব্যস্ত হবে। পূনরায় চাকরীতে বহাল থাকবে ও পূর্বের মত রাজাকে সূরা পান করাবে। আর দ্বিতীয় জনের শূলদন্ড হবে এবং পাখীরা তার মৃত্যুর পর তার মাথার মগজ খাবে। তারপর সত্যিই ইউসুফ (আঃ) এর স্বপ্নের ব্যাখ্যা বাস্তবে পরিনত হলো।

ইউসুফ (আঃ) মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদীকে বলে দিলেন, যেন রাজার কাছে তার কথা উল্লেখ করে। লোকটিকে শয়তান ভুলিয়ে দিলো। তিনি তখন রাজার কাছে ইউসুফ (আঃ) প্রসঙ্গে কিছু বললেন না। ইউসুফ (আঃ) কে আরো কয়েক বছর কারাগারে থাকতে হলো।

একদা রাজা স্বপ্ন দেখলেন যে, সাতটি হৃষ্টপুষ্ট গরু অন্য সাতটি জীর্ন-শীর্ন গরুকে খেয়ে ফেলেছে। আরো দেখলেন, সাতটি তরতাজা সবুজ রঙের শস্য ছড়া, সাতটি শুষ্ক ছড়া। শুষ্ক ছড়াগুলো সাতটি তরতাজা ছড়াকে জড়িয়ে ধরে শুষ্ক করে ফেলছে। রাজা সভার গন্যমান্য সবার কাছে তাঁর স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। কিন্তু কেউই এই স্বপ্নগুলোর যথাযথ ব্যাখ্যা দিতে পারলো না। তারা বললো, এগুলো হলো মনের বিভিন্ন জল্পনা-কল্পনার সমষ্টিগত বাস্তবতাহীন স্বপ্ন। তখন কারাগারে মুক্তিপ্রাপ্ত লোকটির ইউসুফ (আঃ) এর কথা মনে পড়লো। এবং সে রাজাকে ইউসুফ (আঃ)এর স্বপ্ন ব্যাখ্যাকারী গুন সম্পর্কে অবগত করলেন। তখন রাজা লোকটিকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার জন্য ইউসুফ (আঃ) এর কাছে পাঠালেন।

রাজার দেখা স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে ইউসুফ (আঃ) জানালেন, সাত বছর ফসল বুনতে হবে, এতে প্রচুর ফসল হবে। তখন শস্য কেটে আনার পর তা গুচ্ছের মধ্যেই রেখে সংরক্ষন করতে হবে। প্রয়োজন মতো কিছু শস্য আহারের জন্য মাড়াই করে নেবে। পরের সাত বৎসর ভীষন দুভিক্ষ হবে। তখন পূর্বের সংরক্ষিত সাত বছরের ফসল প্রায় সবই খেয়ে শেষ হয়ে যাবে। সামান্য কিছু শস্য বীজের জন্য সামলিয়ে রাখবে। পরবর্তীতে আবার সুদিন আসবে। বৃষ্টি হবে এবং ফল-ফলারীর রস চিপে জমা করার সুযোগ আসবে।

ইউসুফ (আঃ) এর এত সুন্দর স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনে রাজা অভিভূত হয়ে পড়লেন। লক্ষ লক্ষ নরনারীর জীবন রক্ষার্থে সাহায্যকারী হিসেবে ইউসুফ (আঃ) এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। তাই ইউসুফ (আঃ) কে রাজার কাছে নিয়ে যেতে আদেশ করলেন।

মিসরে ইউসুফ (আঃ) এর রাজকীয় দায়িত্ব পালন ঃ 

  
ইউসুফ (আঃ) দীর্ঘ দশ বৎসর মিথ্যা অপবাদে কাটিয়েছিলেন। তারপর রাজদরবারে স্বয়ং রাজা তার সাথে দেখা করতে চাইলেন। ইউসুফ (আঃ) এর আতœমর্ষাদা বোধ খুব বেশী ছিল। তাই তিনি দশ বৎসর পূর্বে তার উপর মিথ্যা অপবাদ উঠিয়ে নেবার আবেদন করলেন। ইউসুফ (আঃ) এর বাসনা অনুযায়ী, রাজা যুলেখার নিমন্ত্রিত নারী অতিথিদের ডেকে সত্যিকার ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করলেন যে, ইউসুফ (আঃ) নির্দোষ। তিনি সম্পূর্ণ খাঁটি ও সত্যবাদী।

রাজা সমস্ত ব্যাপার পর্যবেক্ষন করে ইউসুফ (আঃ) এর উপর আরোপিত সকল অপবাদ হতে তাঁকে মুক্ত করলেন এবং সসম্মানে রাজ দরবারে আমন্ত্রন করলেন। ইউসুফ (আঃ) কে রাজ্যের সম্পদ ভান্ডারের কর্তৃপদে নিয়োগ করলেন। কারাগারে কয়েদী ইউসুফ (আঃ) আজ সেদেশেরই রাজকীয় মর্যাদা প্রাপ্ত। একেই বলে আল্লাহর রহমত। আল্লাহ তাঁর নেক বান্দাদের কর্মফল ইহকালে নষ্ট করেন না। আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত নেয়ামত।

ইউসুফ (আঃ) নিজ বুদ্ধি-বিবেচনামতো ভবিষ্যৎ দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করার জন্য কাজ করে যেতে লাগলেন। সাত বছর ভীষন ভালো ফসল হলো। বাড়তি সব শস্য জমা করে রাখলেন। পরে দেখা দিল চরম দুর্ভিক্ষ। মিসরের কাছে সিরিয়া ও কেনান অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়লো দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষের সময় মিশরের সরকারী ভান্ডার হতে লোকদের খাদ্য ক্রয়ের সুযোগ দেয়া হলো। ইউসুফ (আঃ) এর ভাইয়েরাও মিসরে খাদ্য ক্রয় করতে এলেন। ইউসুফ (আঃ) তাঁর সৎ ভাইদের চিনলেন কিন্তু ভাইয়েরা তাঁকে চিনলো না।

শস্য ক্রয়ের সময় প্রত্যেক পরিবারের জনসংখ্যার বিবরন দিতে হয়। ইউসুফ (আঃ) এর ভাইয়েরাও তাদের পরিবারের তথ্য দিয়েছিলো। সেখানে তাদের ছোট ভাই বিনইয়ামীনের নাম ছিল। কিন্তু সে তাদের সাথে আসেনি। ইউসুফ (আঃ) তার ভাইদের বলে দিলেন, যেন পুণরায় আসবার সময় বিনইয়ামীনকে নিয়ে আসে। তা’না হলে খাদ্য দেয়া হবে না। তারপর, ভাইদের শস্যের বস্তার মাঝে গোপনে তাদের দেয়া শস্যের মূল্যসমূহ আবার ফেরত দিয়ে দিলেন।

ইউসুফ (আঃ) এর ভাইয়েরা বাড়ীতে আসার পর খাদ্যমূল্য পুনরায় ফিরে পেয়ে অত্যন্ত খুশী হলেন এবং এবারে বিনইয়ামীনকে সাথে নিয়ে যেতে চাইলেন। ইয়াকুব (আঃ) এর কাছে বিনইয়ামীনকে হেফাজতে রাখার ওয়াদা করে ভাইয়েরা সবাই মিলে আবারো মিসরে এলেন শস্য নিতে। ইউসুফ (আঃ) বিনইয়ামীনকে গোপনে ডেকে নিয়ে নিজ পরিচয় দিলেন। এবং তাকে কাছে রাখার বাসনা ব্যাক্ত করলেন।

ইয়াকুব (আঃ) এর দেশের নিয়ম ছিল যে, চোরকে মালিকের গোলাম হয়ে থাকতে হতো। ইউসুফ (আঃ) এর ছোটবেলায় তাঁর ফুফু তাঁকে নিজের কাছে রাখার উদ্দেশ্যে ফন্দি করেছিলেন। তিনি নিজের একটি রুপার চেইন ইউসুফ (আঃ) এর কোমরে গুজে দেন। পরে চুরির শাস্তিস্বরুপ ইউসুফ (আঃ) কে তার ফুফু মৃত্যু পর্যন্ত নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। ইউসুফ (আঃ) এবারে বিনইয়ামীনকে নিজের কাছে রেখে দেবার জন্য তেমনই বুদ্ধি করলেন। বিনইয়ামীনের শস্যের বস্তার মাঝে শস্য মাপার রুপার বাটি গোপনে গুজে রাখলেন। বিনইয়ামীন সহ ভাইয়েরা বাড়ীর পথে রওয়ানা দিলে, তাদেরকে রাজার কর্মচারীরা তাল্লাশি করলো ও বিনইয়ামীনের শস্যের বস্তায় হারানো রুপার বাটি পেল।

চুরির শাস্তিস্বরূপ বিনইয়ামীনকে ইউসুফ (আঃ) এর কাছে রেখে দিলেন। ভাইয়েরা ইউসুফ (আঃ) কে বললেন, ‘হে আজীজ, এই ছেলেটির বৃদ্ধ পিতা আছে। তাকে রাখলে তার পিতা প্রায় পাগোল হয়ে যাবেন। এর পরিবর্তে আপনি আমাদের কাউকে রেখে দিন।’ হযরত ইউসুফ (আঃ) বললেন, ‘একজনের দোষের শাস্তি অন্যজনকে দেয়া যাবে না। তাহলে আমরা অন্যায়কারী সাব্যস্ত হবো।’

বিনইয়ামীনের আশা ত্যাগ করে ভাইয়েরা বাড়ী ফিরে এলেন। এবং তাদের পিতাকে সব ঘটনা খুলে বললেন। ইয়াকুব (আঃ) ভীষন দুঃখ পেলেন। তারপরও ধৈর্য্য সহকারে আল্লাহর ফয়সালার অপেক্ষা করতে লাগলেন। আল্লাহতা’য়ালা সর্বোত্তম ফয়সালাকারী। ইউসুফ (আঃ) ও বিনইয়ামীনের শোকে কাঁদতে কাঁদতে ইয়াকুব (আঃ) এর চক্ষু সাদা হয়ে দৃষ্টিশক্তি চলে গেল এবং চিন্তায় শ্বাস রূদ্ধ হয়ে পড়লো।

ইয়াকুব (আঃ) কাউকে দোষারুপ করলেন না। তিনি তাঁর সমস্ত দুঃখ-যাতনা, আবেদন-নিবেদন একমাত্র আল্লাহর কাছেই পেশ করতে লাগলেন। মুমিন বান্দাদের এরূপ কোন দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা-ব্যার্থতায় কাউকে দোষারুপ না করে সমস্ত অভাব-অভিযোগ একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছেই পেশ করা উচিৎ। পৃথিবীর যাবতীয় সবকিছু আল্লাহর হুকুমেই চলে। অতএব ধৈর্য্য সহকারে পূর্ন ভরসা করা উচিৎ। আল্লাহ তা’য়ালাই সর্বোত্তম হেফাজতকারী এবং তিনি সর্বাধিক দয়ালু।

‘কাফের ছাড়া অন্য কারো আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হওয়া উচিৎ নয়।’ তাই ইয়াকুব (আঃ) এর পরামর্শমতো তাঁর ছেলেরা ইউসুফ (আঃ) ও বিনইয়ামীনের খোঁজে বের হলেন। ইউসুফ (আঃ) এর ভাইয়েরা রেশনের বাহানায় আবারো মিসরের সরকারী কর্মকর্তা আজীজ অর্থাৎ ইউসুফ (আঃ) এর কাছে পৌঁছালেন। এবার ইউসুফ (আঃ) ভাইদের কাছে নিজ পরিচয় দিলেন। ভাইয়েরা তখন তাদের অতীত ভুলক্রটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলো। ইউসুফ (আঃ) বললেন, ‘আল্লাহ আমাদের উপর অনুগ্রহ করেছে। সত্যিই যারা গোনাহ হতে বেঁচে থাকে এবং বিপদে ধৈর্য্যধারন করে আল্লাহ তাদের কর্মফল নষ্ট করেন না।

ইউসুফ (আঃ) ভাইদের ক্ষমা  করে দিলেন। এবং তাঁর নিজের একটি জামা তাঁর বাবা অর্থাৎ ইয়াকুব (আঃ) এর জন্য দিলেন। বললেন, জামাটি পিতার চোখের উপর রাখলেই ইনশা-আল্লাহ তিনি তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন।’ হযরত ইউসুফ (আঃ) এর জামা নিয়ে ভাইয়েরা মিসর ত্যাগ করলেই ইয়াকুব (আঃ) ইউসুফ (আঃ) এর সুঘ্রান অনুভব করতে লাগলেন। ইউসুফ (আঃ) এর কথা সত্য হলো। জামা চোখের উপর রাখতেই ইয়াকুব (আঃ) পূনরায় দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন। ইউসুফ (আঃ) এর ভাইয়েরা পিতা ইয়াকুব (আঃ) এর কাছে নিজেদের দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইলো।

ইউসুফ (আঃ) এর পিতা-মাতা ও পরিবারবর্গ কেনান হতে মিসরে যাত্রা করলেন। পিতা-মাতার আগমন সংবাদে ইউসুফ (আঃ) অনেকটা অগ্রসর হয়ে তাদেরকে সঙ্গে করে মিসর শহরে নিয়ে এলেন। ইউসুফ (আঃ) নিজ পিতা-মাতাকে রাজকীয় আসনে স্থান দিলেন। সকলের অন্তরে ইউসুফ (আঃ) এর জন্য অনেক শ্রদ্ধার জন্ম নিল। তারা সবাই মিলে ইউসুফ (আঃ) কে সম্মান সূচক সেজদা করলেন। এবং এভাবে ছোট বেলায় দেখা ইউসুফ (আঃ) এর স্বপ্ন সত্যি হলো। আল্লাহ যা করতে ইচ্ছা করেন, অত্যন্ত সুনিপুণ কার্যকৌশলের দ্বারা তা তিনি সম্পন্ন করেন।

অনেকের মতে যোলেখার স্বামী উজিরে আযমের মৃত্যুর পর ইউসুফ (আঃ) এর সাথেই তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর যোলেখার প্রতি হযরত ইউসুফ (আঃ) এর মহব্বত অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু ইউসুফ (আঃ) এর প্রতি যোলেখার মহব্বত কমে যায়। ইউসুফ (আঃ) এই ব্যাপারে যোলেখাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন যে, ইউসুফ (আঃ) এর মাধ্যমেই তিনি আল্লাহর মহব্বত লাভ করেছেন। আর আল্লাহর মহব্বতের কাছে অন্য সব মহব্বতই ম্লান হয়ে যায়।

সবকিছু ফিরে পেয়ে ইউসুফ (আঃ) আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ ও যমীনের তথা সারা জাহানের সৃষ্টিকর্তা আপনি আমাদের অভিভাবক ইহকাল ও পরকালের। চিরকাল আপনার খাঁটি বান্দা হিসেবে আমাদের কবুল করুন। এমন অবস্থায় মৃত্যুবরন করান যেন আপনার প্রিয় ও নেক বান্দাদের শামীল হতে পারি। আমীন’।
------------------------------------------------------------
তথ্যসূত্র ঃ
আল্ কোরআন: সূরা ইউসুফ, পারা ১২-১৩।

প্রকাশ ঃ দৈনিক ইনকিলাব,
১ম কিস্তি ১৪ মার্চ ২০১০, শেষ কিস্তি ১৬ মার্চ ২০১০।       

-----------------------------------------------------------------                         
       By 

Khandaker Nazneen Sultana, 
Journalist

No comments:

Post a Comment