It is now

Wednesday, April 10, 2013

বইয়ের নামঃ ফী ত্বলাবুল জান্নাত (জান্নাতের খোঁজে)



লেখক ঃ খন্দকার নাজনীন সুলতানা

১. রোজা ও স্বল্প আহারেই দেহ-মন সুস্থ/ রোজা দেহ ও মনের সুস্থতার নিয়ামক
          
হুযুরে পাক (সাঃ) বলেচেন, ‘অল্প হাস্য এবং অল্প আহার করে হৃদয়কে সজীব কর এবং ক্ষুধা দ্বারা তাকে পবিত্র কর। যে ব্যক্তি উদরকে ক্ষুধিত রাখে, তার চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি হয় এবং হৃদয় প্রখর ও সতেজ হয়।’


হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, হুযুরে পাক (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি পরিতৃপ্ত আহার করে এবং নিদ্রা যায়, তার হৃদয় কঠিন হয়। প্রত্যেক বস্তুরই যাকাত আছে। শরীরের যাকাত হলো ক্ষুধা।”

হুযুরে পাক (সাঃ) আরো এরশাদ করেছেন, “ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা দ্বারা তোমরা তোমাদের প্রবৃত্তির সাথে লড়াই কর। কেননা তার মধ্যে পূন্য রয়েছে।”

বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসাবিদ ইবনে সীনা তাঁর রোগীদেরকে তিন সপ্তাহ রোযা থাকার নির্দেশ দিতেন। রোগ নিরাময়ের যতগুলো প্রতিরোধক ও প্রতিকার আছে, রোযা তম্মধ্যে সবচেয়ে বেশী কার্যকর ও ফলপ্রসু। সারা বছর অধিক ভোজনের ফলে দেহে যে জৈববিষ বা টক্্িরন জমা হয়, তা স্নায়ু এবং অপরাপর জীবকোষগুলোকে দূর্বল করে দেয়। রোযার মাধ্যমেই ঐ সব জৈববিষ সমূহ দূরীভূত করা সহজ হয়।
চিকিৎসাবিদগণ বলেছেনÑ যখনই একবেলা খাবার বন্ধ থাকে, তখনই দেহ সেই মুহুর্তটিকে রোগ মুক্তির সাধনায় নিয়োজিত করে।

ক্ষুধা আত্মাকে নির্মল ও পরিস্কার করে, স্বভাবকে সতেজ করে এবং দৃষ্টিকে সূক্ষ্ম করে। পক্ষান্তরে পরিতৃপ্ত আহারে অলসতা জম্মায়। যে ব্যক্তি অতিরিক্ত আহার করে তার স্মরণশক্তি অকর্মন্য হয়ে যায়, তার বুদ্ধি হ্রাস পায় এবং সে নির্বোধ ও বোকা হয়ে যায়।

হুযুরে পাক (সাঃ) বলেছেন, ‘ক্ষুধাই হেকমতের নূর, পরিতৃপ্ত আহার আল্লাহকে দূরে রাখে। দরিদ্রের প্রতি ভালবাসা এবং তাদের নিকটবর্তী হওয়াই আল্লাহকে নিকটে নিয়ে আসে। তৃপ্তিসহকারে আহার করো না, তাতে হেকমতের নূর তোমাদের হৃদয় থেকে নির্বাপিত হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি অল্প আহার করে রাত কাটিয়ে দেয়, ভোর পর্যন্ত নূর তার চারদিকে বিচরন করে।’

হযরত শিবলী (রহ:) বলেছেন, “আমি যেদিনই আল্লাহর সন্তুষ্টিকল্পে ক্ষুধার্ত ছিলাম, সেদিনই আমি দেখেছিলাম যে, আমার হৃদয় হেকমত এবং উপদেশের দিকে এমনভাবে উম্মুক্ত হয়েছে যে, আমি তা অন্য কখনও দেখি নি।”

হযরত আবু ইয়াযিদ (রহ:) বলেছেন, 'ক্ষুধা মেঘ সদৃশ, যখন কোন ব্যক্তি ক্ষুধার্ত হয়, হৃদয় তখন হেকমতের বৃষ্টি বর্ষন করে।' বর্তমানে এক শ্রেণীর উচ্চ ডিগ্রিধারী ও অত্যাধুনিক ব্যক্তিরা রোজাকে অস্বীকার করে এবং রোযা রাখার কোন গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে না। এমনকি রোযাকে তারা দেহ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলেও অপপ্রচার করে থাকে। অনেক চিকিৎসকও গ্যাস্ট্রিক, আলসার, হাইপার এসিডিটি প্রভৃতি রোগীদেরকে রোজা রাখতে বারণ করে থাকে।

অথচ রোযার আর এক উপকার হলো স্বাস্থ্য রক্ষা ও ব্যাধির বিলুপ্তি। অল্প আহারে স্বাস্থ্য রক্ষা হয় এবং রোগব্যধি দূর হয়। অতিরিক্ত ভোজনই হাজারো রোগের কারণ।

এ প্রসঙ্গে একটি সত্যি ঘটনার অবতারনা করা যায়। খলিফা হারুনুর রশীদ একসময় ভারতবর্ষ, রোম, ইরাক এবং আবিসিনিয়া দেশ থেকে চারজন চিকিৎসক সংগ্রহ করে তাদেরকে বলেলেন, ‘আপনাদের মধ্যে প্রত্যেকেই আমাকে এমন ঔষধ দেবেন, যাতে আমার আর কোন রোগ না হয়।’

ভারতবর্ষের চিকিৎসক বললেন, ‘সে ঔষধ হলো “কাল আহলীজ।” ইরাকের চিকিৎসক বললেন, ‘তা স্বেত বর্ণের হেলেঞ্চার দানা। রোমের চিকিৎসক বললেন, ‘তা গরম পানি।’ হাবসার চিকিৎসক সর্বাপেক্ষা অভিজ্ঞ ছিলেন। তিনি বললেন, ‘আহলীজ ঔষধে পাকস্থলী সংকীর্ণ হয়ে যায়। এটাও একপ্রকার রোগ জন্মায়। হেলেঞ্চার দানা পাকস্থলীকে নরম করে এবং এটাও এক প্রকার রোগ জন্মায়। গরম পানিও পাকস্থলীকে নরম করে, এটাও এক প্রকার ব্যধির জন্ম দেয়। তখন অন্যান্য চিকিৎসকগন তার কাছে কি ঔষধ আছে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘খলিফার জন্য আমার ঔষধ হলো, ‘ক্ষুধা না হলে তিনি যেন আহার না করেন এবং আহারের সময় কিছু ক্ষুধা বাকী থাকতেই যেন আহার থেকে হাত উঠিয়ে নেন।’ তখন তারা সবাই একযোগে স্বীকার করলেন যে, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন।’  (এহইয়াউ উলূমিদ্দীন)

হাদীসে আছে, নবীকরীম (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা উদরের এক তৃতীয়াংশ খাদ্য দ্বারা, এক তৃতীয়াংশ পানি দ্বারা পূর্ণ কর ও এক তৃতীয়াংশ নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের জন্য ফাঁকা রাখো।’
হুযুর পাক (সাঃ) আরো বলেছেন, 'ভুরীভোজন রোগের মূল এবং পানাহারের নিয়ন্ত্রণ নিরোগ থাকার মূল।'

হযরত ইবনে সালেম (রহঃ) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি বিশুদ্ধ যবের রুটি নিয়মানুযায়ী ভক্ষণ করে, তাকে মৃত্যু রোগ ব্যতীত অন্য কোন রোগ আক্রমন করতে পারে না।’ তাকে জিজ্ঞেস করা হল, নিয়মানুযায়ী ভক্ষণ করার অর্থ কি? তিনি বললেন, ‘ক্ষুধা পাবার পরে আহার করা এবং উদর তৃপ্ত না করেই ভক্ষণ শেষ করা।’

দেহ ও আত্মা উভয়ের সুস্থ্যতার জন্যই রোজার ভূমিকা অপরিসীম। একমাত্র রোযার মাধ্যমে পাকস্থলী বিশ্রাম পায়। রোযা শরীরের রক্ত প্রবাহকে পরিশোধন করে। উচ্চরক্ত চাপ জনিত ব্যাধি ও পেপেটিক আলসার যৌনাঙ্গ ও অন্ডকোষের বিবিধ রোগের উপশমের ক্ষেত্রে রোজার বিকল্প নেই।

প্রসিদ্ধ চিকিৎসক ডঃ ডিউ বলেছেন, “রোগক্লিষ্ট মানুষটির পাকস্থলী থেকে খাদ্য দ্রব্য সরিয়ে ফেল, দেখবে রুগ্œ মানুষটি উপবাস থাকছে না। মূলতঃ উপবাস থাকছে রোগটি।

রোযায় হৃদয় কোমল ও নির্মল হয়। এতে যিকির ও মোনাজাতের মিষ্টি আস্বাদ সুন্দর ভাবে অনুভব করা যায়। হযরত আবু সোলায়মান দারানী (রহঃ) বলেছেন, 'যখন আমার পিঠ উদরের সাথে লেগে গিয়েছিল, তখনই আমি ইবাদতে আস্বাদ পেয়েছি।'

হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রহঃ) বলেছেন, "যে ব্যক্তি তার ও তার বক্ষের মধ্যবর্তী স্থানে খাদ্যের ডালা স্থাপন করে মুনাজাতের আস্বাদ পেতে চায়, তার আশা সফল হবে না। তিনি আরো বলেছেন, যখন উদর ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হয় তখন তা নির্মল ও কোমল হয়, যখন তা পরিতৃপ্ত আহারে তুষ্ট হয়, তখন তা অন্ধ ও কঠিন হয়। যখন হৃদয় মুনাজাতের স্বাদ পায় তখন আল্লাহর বিষয়ে চিন্তা করা সহজ হয় এবং মারেফাতে তত্ত্বজ্ঞান বৃদ্ধি পায়।"

রোযা দ্বারা যত সহজে প্রবৃত্তিকে বশীভূত করা যায়, অন্য কিছুর দ্বারা ততটা সম্ভব হয় না। রোযায় দীনতা উপলব্ধি করা যায়, মিথ্যা অহঙ্কাার ও আমোদ-প্রমোদ দূরীভূত হয়। ফলে আল্লাহর কাছাকাছি যাওয়া সহজ হয়।

এজন্যই হুযুরে পাক (সাঃ) এর সম্মুখে দুনিয়ার সকল ধনসম্পদ উপস্থিত করা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, “আমি একদিন ক্ষুধার্ত থাকা ও তার পরদিন আহার করাকে পছন্দ করি। যেদিন ক্ষুধার্ত থাকবো, সেদিন আমি ধৈর্যের সাথে বিনম্র হব। যেদিন আহার করবো, সেদিন আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো।’

ইমাম গাযযালী (রহঃ)- এর মতে, ‘উদর এবং কামরিপু দোযখের দরজা। এর মূল হলো ভূরিভোজন, নম্রতা এবং ভগ্নহৃদয়তা বেহেশতের দরজা। এর মূল হলো ক্ষুধা। যে ব্যক্তি দোষখের দরজা বন্ধ করে দেয়, সে নিশ্চয়ই তখন বেহেশতের দরজা উম্মুক্ত করে। কেননা উভয় দরজাই পূর্ব ও পশ্চিমের ন্যায়। পরস্পর মুখোমুখি। কেউ এক দরজার নিকটবর্তী হলে অন্য দরজা হতে দূরবতী হতেই হয়।’  
রক্ত, স্নায়ু ও দেহের গ্রন্থিসমূহের উপর রোজার সুফল ও প্রতিক্রিয়া সর্বাধিক। রোজা মস্তিস্ক ও স্নায়ুতন্ত্রকে সর্বাধিক উজ্জীবিত করে। এতে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল ভাবে চিন্তা-ভাবনা করা সহজ হয়। রোজা মস্তিষ্কের কোষগুলোকে জীবানুমুক্ত করে ও স্বচ্ছ রক্ত প্রবাহে সাহায্য করে। ফলে মস্তিষ্ক গভীর ও ব্যাপক ভাবে চিন্তা-ভাবনা করার শক্তি অর্জন করে।

জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত অমূল্য সম্পদ। এই পৃথিবী নামক পরীক্ষাক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই আমরা হাজারো পরীক্ষার সম্মুখীন হচ্ছি। জীবন ভোগের জন্য নয়, ত্যাগের জন্য। আর এই ত্যাগ চর্চার অন্যতম মাধ্যমই হচ্ছে রোজা। রোজায় ইবাদত করা সহজ হয়। অতিরিক্ত ভোজনে ইবাদতে বিঘœ ঘটে।

হযরত আবু সোলায়মান দারানী (রহঃ) পরিতৃপ্ত ভোজনের ছয়টি আপদের কথা উল্লেখ করেছেন। "তাঁর মতে, (১) পরিতৃপ্ত ভোজনে মুনাজাতের আস্বাদ পায় না। (২) হেকমত বা বিজ্ঞানের বিষয় স্মরণ রাখতে পারে না। (৩) লোকজনের উপর দয়া প্রদর্শনের গুন লোপ পায়। কারণ সে মনে করে সবাই নিশ্চই তার মত উদর পূর্ণ করে আহার করেছে। (৪) ইবাদত কার্যে সে কষ্ট অনুভব করে। (৫) কামপ্রবৃত্তি ও লালসা তার মনে প্রবল হয়। (৬) যে সময়ে অন্যান্য মুছল্লীগন মসজিদে যাতায়াত করে, সে সেই সময়ে পায়খানায় আবদ্ধ থাকে।" 

খাওয়ার জন্য বাঁচা নয়, বাঁচার জন্য খাওয়া, এই যেন হয় আমাদের আদর্শ। হযরত ছহল তশতরী (রহঃ) কে তাঁর আহারের পরিমান সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি উত্তরে বলেছেন, “তিন দেরহাম ব্যয়ে আমার সারা বছরের আহারের ব্যবস্থা হয়ে যেত। এক দেরহাম দিয়ে আটা কিনতাম এক দেরহাম দিয়ে মিহিন চাল আর এক দেরহাম দিয়ে ঘি কিনতাম। সবগুলো মিলিয়ে তিনশ ষাটটি লাড্ডু তৈরী করে নিতাম। প্রতিদিন সন্ধায় ইফতার করে এক এক লাড্ডু ভক্ষন করতাম।’ তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, এখনওকি আপনার তদ্রুপ অভ্যাস আছে? তিনি বললেন, ‘এখন কোন সীমা নাই, কিছু পেলে খাই, না পেলে ধৈর্য ধারন করি।’

হযরত আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) বলেন, “হুযুরে পাক (সাঃ) যদি প্রাতে আহার করতেন, তবে রাতের বেলা আর কিছু খেতেন না, রাতের বেলায় আহার করলে তার পরদিন ভোরে আর কিছু খেতেন না।”
হাদীসে আছে, হুজুরে পাক (সাঃ) হযরত আয়শা (রাঃ) কে বলেছিলেন, “হে আয়শা! খবরদার অপচয় করো না। দুবেলা আহারে অপচয় হয়।”

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আরো বলেছেন, “আমার উম্মতদের মধ্যে যাদের আহার উপাদেয় খাদ্য এবং যাদের দেহ তার উপরই বর্ধিত, যাদের নানা প্রকার খাদ্য এবং বেশভূষাই চরম লক্ষ্য, যারা দীর্ঘ সময় অনর্থক বাক্য ব্যয় করে তারা জঘন্য।”

হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বলেন, মু’মিন ব্যক্তি মেষের ন্যায়। এক মুষ্টি শাক, এক মুষ্টি ছাতু আর এক অঞ্জলী পানিই তার জন্য যথেষ্ট। পক্ষান্তরে, মুনাফিক হিংস্র পশুর ন্যায় গলিত মাংস চর্বন করে। আনন্দে বিচরন করে এবং সে বহু পরিমান খাদ্য আহার করে। সে তার ভ্রাতার জন্য উদ্ধৃত্ত খাদ্য রেখে দেয় না।

মুমিন ব্যক্তি শুধু জীবন রক্ষার তাগিদেই আহার করে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, 'আহার কর, পান কর কিন্তু অপব্যয় করো না।' অথচ অধিকাংশ লোকই খাদ্য অপব্যয় করে। ক্ষুধা না লাগলে খাওয়াটাও একটা অপব্যয়।
ইমাম গাযযালী (রহঃ)- এর মতে, 'সত্য বা প্রকৃত ক্ষুধা চিনে নেয়ার কিছু কৌশল বা উপায় রয়েছে। প্রথম কৌশল হল, ব্যঞ্জন ছাড়াও আহার করার ইচ্ছা হওয়া। অন্নের সাথে তরকারী বা মাছ-মাংসের অনুসন্ধান করলে তখন বুঝতে হবে যে, প্রকৃত ক্ষুধা হয় নি। দ্বিতীয় কৌশল হল আহারের ব্যঞ্জন পাত্র বা বরতন থেকে এমন ভাবে চেটে খাওয়া যেন তাতে মাছি না পড়ে।” ভালোভাবে বর্তন চেটে খেলেই বুঝতে হবে, আরো একটু ক্ষুধা বাকী আছে।”

আর মু’মিন বান্দাদের সবসময়ই পেটে কিছুটা ক্ষুধা রাখা উচিৎ। কারণ ব্যক্তি ক্ষুধার্থ ও তৃষ্ণার্থ থাকলেই তার পক্ষে পরকালে দোযখীদের ক্ষুধার কথা স্বরণ করা সহজ হয়। ক্ষুধাই উত্তম দুঃখ ও কষ্ট। নবী ও আওলিয়াগন যেসব দুঃখ-কষ্ট দ্বারা পরীক্ষিত হয়েছিলেন, তম্মধ্যে ক্ষুধা অন্যতম।

 একবার হযরত ইউসুফ (আঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “আপনার হস্তে রাজ্যের ধন-রতœ থাকা সত্ত্বেও আপনি কেন ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছেন? তদুত্তরে তিনি বললেন, “পরিতৃপ্ত আহার করলে আমার ভয় হয় যে, ক্ষুধিত জনের ও দরিদ্রদের কষ্ট ভুলে যেতে পারি। এটা ক্ষুধার একটি উপকারিতা। কেননা তা মানুষের উপর দয়া, খাদ্য প্রদান এবং সহানুভূতি শিক্ষা দেয়। যারা পরিতৃপ্ত আহার করে, তারা ক্ষুধার্থের ক্লেশের বিষয় ভুলে থাকে।”

রোযায় মানুষের মানবিক অধিকার ও অনুভূতিগুলো খুব তীক্ষè হয়। স্বরণ শক্তি বৃদ্ধি পায়। মনোসংযোগ ও যুক্তিশক্তি বাড়ে। ঘ্রাণ শক্তি, দৃষ্টি শক্তি, শ্রবণ শক্তিও বহুগুনে বেড়ে যায়। রোযায় পাপ প্রবৃত্তি দমন থাকে। ক্ষুধা পাপের সব লোভ লালসাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে এবং নফসে আম্মারাহ বা অসৎ প্রবৃত্তিগুলোকে বশীভূত করে রাখে।

খারাপ প্রবৃত্তি দমনের ক্ষমতা লাভই সব সৌভাগ্যের মূল এবং প্রবৃত্তির অধীন হওয়াকেই সব দূর্ভাগ্যের মূল বলা হয়। আর দুধর্ষ প্রবৃত্তিগুলোকে দমন করতে রোযার ভূমিকা অপরিসীম।

হযরত যুননূন মিসরী (রহঃ) বলেছেন, “যখনই আমি তৃপ্তির সাথে আহার করেছি, তখনই আমার মনে পাপ বা পাপের খেয়াল উদয় হয়েছে।”

হযরত আয়শা (রাঃ) বলেছেন, “হুযুরে পাক (সাঃ)- এর পরলোক গমনের পর সর্বপ্রথম যে বেদয়াত সৃষ্টি হয়েছিল, তা’হল পরিতৃপ্ত আহার।”

যেসব লোক উদর পূর্ণ করে ভোজন করে তাদের প্রবৃত্তিগুলো সবসময় তাদেরকে সংসারের দিকে আকর্ষিত করে রাখে ও পরকালকে ভুলিয়ে রাখে।

জনৈক মহাপুরুষ বলেছেন, “আল্লাহতা’লার রতœভান্ডারের মহারতœ হলো ক্ষুধা। ক্ষুধা দ্বারা সর্বাপেক্ষা নূনতম যে আপদ দূর করা যায়, তা’হল কামরিপু, প্রবৃত্তি এবং বলার আকাঙ্খা। ক্ষুধার্থ ব্যক্তি অতিরিক্ত কথা বলতে চায় না। তাই সে পরনিন্দা, অশ্লীল বাক্য, মিথ্যা কথা ইত্যাদি রসনার দোষ হতে মুক্তি পায়।”

অতিভোজনের ফলে অনেকেরই পাকস্থলী বড় হয়ে যায়। রোযা রাখলে এই পাকস্থলী আবার ধীরে ধীরে স্ব অবস্থানে ফিরে আসে। রোযায় পরিপাকতন্ত্র বিশ্রামে থাকে ও জীবানুমুক্ত থাকে। বৃহদাকার যন্ত্র এই পাকস্থলীর বিশ্রামের অন্যতম মাধ্যমও হলো রোযা। তৃপ্তিসহকারে ভোজনে মানুষের পশুপ্রবৃত্তি বেড়ে যায়। এ সম্পর্কে ইমাম গাযযালী (রহঃ) বলেছেন, যখন মানুষ তৃপ্তি সহকারে ভোজন করে, তখন সে কামইন্দ্রিয়কে দমন রাখতে পারে না। যদি আল্লাহর ভয়ে তা দমন করে রাখেও তবে, চোখের ব্যভিচার করতে থাকে। যদি চোখকে সে এদিক সেদিকে কুদৃষ্টি থেকে ফিরিয়েও রাখে, কিন্তু সে মনকে দমন করতে পারে না। নানা কুচিন্তা ও অসৎ খেয়াল তার মনে আসে। মুনাজাতে সে আস্বাদ পায় না। অনেক সময় নামাজের মধ্যেও বহুবিধ চিন্তা এসে জড় হয়ে থাকে।”

অর্থাৎ রোজার দ্বারাই মানুষের দেহ ও মন দুইই সুস্থ, সবল ও স্বাভাবিক রাখা সম্ভব। আয়ু মানুষের জীবনের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান বস্তু। মানুষের ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি হতেও আয়ু অধিক মূল্যবান। আর নিদ্রা মৃত্যুস্বরুপ। রোযায় ঘুমানোর জন্য কম সময় ব্যয় হয় ও ইবাদতের জন্য বেশী সময় পাওয়া যায়। রোজা ও স্বল্প আহারের গুরুত্ব অপরিসীম।

হযরত সাররী ছাকতী (রহ:) বলেছেন, “হযরত আলী (রাঃ) জুরজানী (রহ:) কে যবের ছাতু পানিতে গুলে পান করতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কেন এরুপ কষ্ট করছেন? তিনি বললেন, রুটি চিবিয়ে খেতে যে সময় লাগে, সে সময়ের মধ্যে আমি সত্তরবার তাসবীহ পড়তে পারবো। সেজন্য বিগত চল্লিশ বছর ধরে আমি রুটি খাইনি।

জীবনের প্রতিটি নি:শ্বাস অমূল্য রতœ। তার যথাযথ সদ্ব্যবহার করতঃ পরকালের জন্য ধন সম্পদ সঞ্চয় করা উচিৎ। এজন্যই যিকির ও ইবাদতেই জীবনের বেশীরভাগ সময় ব্যয় করা বুদ্ধিমানের কাজ। যিকির ও ইবাদতের জন্য সারাদিন জায়নামাযে বসে থাকার প্রয়োজন নেই। পবিত্র ও শুদ্ধ নিয়তে দৈনন্দিন কাজ-কর্মের মধ্য দিয়েই বান্দা সারাদিন আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী করতে পারে।

হযরত ছহল তশতরী (রহঃ) বলেছেন, “পেটুক লোক তিনটি অবস্থায় নিন্দনীয় ফল দেয়।” যদি সে আবেদ হয়, ইবাদাতে সে অলসতা করে। ব্যবসায়ী হলে সে বিপদ থেকে নিরাপদ থাকে না আর যদি কোন ব্যাপারে তার নিকট আসে, সে নিজ থেকে তার সুবিচার করে না।”

হুযুরে পাক (সাঃ) বলেছেন, ক্ষুধার দ্বারা বেহেশতের দরজায় খটখটি দাও। যে ব্যক্তি দৈনিক একটি রুটি আহার করে তৃপ্ত থাকে, তার অবশিষ্ট লোভ তুষ্ট থাকে। অভাব থেকে সে মুক্ত হয়। মানুষের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় না। সে দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পায় এবং আল্লাহর এবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে আখেরাতের ব্যবসার জন্য সম্পূর্ণরুপে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে।

রোজার দ্বারা আত্মদাম্ভিকতা দূর হয় এবং মন দান খয়রাতে উদ্বুদ্ধ হয়। হাদীসে আছে, মহানবী (সাঃ) বলেছেন, "সেদিন প্রত্যেকেই যার যার নিজের দানের ছায়াতলে থাকবে। যা সে ভক্ষন করে তা’তার পায়খানারুপে সঞ্চিত থাকে। তাই প্রতিদিনই উচিৎ কিছু টাকা-পয়সা ও খাদ্য মানুষকে দান করা। দানে ইহকাল ও পরকাল উভয় কালেই মান-সম্মান বৃদ্ধি পায়।

হুযুরে পাক (সাঃ) একদা এক ভূড়িওয়ালা ব্যক্তিকে দেখে তাঁর পবিত্র অঙ্গুলী দিয়ে লোকটির ভূড়ির প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, "এগুলো যদি অন্য কাজে ব্যয় করতে, তোমার পক্ষে তা উত্তম হত।"

রোযার উপকারের শেষ নেই। রোজা ও স্বল্পআহার পরকালের জন্য বহু মূল্যবান রতœ। একজন প্রবীন বুযর্গ বলেছেন, ‘ক্ষুধা পরকালের কুঞ্জী এবং বৈরাগ্যের দরজা। পক্ষান্তরে পরিতৃপ্ত আহার সংসারের কুঞ্জি ও লালসার দরজা।’

যে রোজা রাখে, সে নিজেই বোঝে রোজার কি কি গুণ ও উপকারিতা আছে। জীবন ভোগের জন্য নয়, ত্যাগের জন্য। ত্যাগের যে তৃপ্তি অনুভূত হয় ভোগ-বিলাস ও লোভ-লালসায় ডুবে থেকে তা কখনও উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

হাদীস শরীফে আছে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘রোজা রাখ, সুস্থ থাকবে।’ রোযা, ক্ষুধা এবং অল্পাহারে শরীর ও মন দুইই সুস্থ্য থাকে। আল্লাহ আমাদের সকলকে রোজা রাখার তৈফিক দান করুন। আমীন। 

প্রকাশঃ বাংলাবাজার পত্রিকা, (ইসলামী ভূবন) ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৮    
                        

বইয়ের নামঃ ফী ত্বলাবুল জান্নাত (জান্নাতের খোঁজে)
লেখক ঃ খন্দকার নাজনীন সুলতানা

২. এইডস প্রতিরোধে ইসলামের ভূমিকা

বর্তমান বিশ্বের অন্যতম নিরাময়হীন রোগ হচ্ছে এইডস (অওউঝ)। এটি এইচ,আই,ভি (ঐওঠ) নামক ভাইরাস বাহিত একটি প্রাণঘাতী রোগ। এই ভাইরাস মানব দেহে প্রবেশ করলে ঐ ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধকারী কোষসমূহকে ধীরে ধীরে ধংস করে ফেলে এবং নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। ভাইরাসটি মানব দেহে ঢোকার পর রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে ক্ষেত্র বিশেষে ৮, ১০ কিংবা ২০ বছরও সময় লেগে যেতে পারে। মানব সভ্যতার জন্য এইডস মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।

১৯৮১ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলস শহরে ৫ জন সমকামীর মাঝে সর্বপ্রথম এই রোগটি ধরা পরে। আর বাংলাদেশে প্রথম এইডস সনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। (সূত্রঃ সিডিসি ১৯৮১)
২০০৮ সালের জুলাই মাসের  টঘঅওউঝ এর রিপোর্ট অনুযায়ী পৃথিবীতে এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩৩ মিলিয়ন। এদের মাঝে মহিলা ১৫ মিলিয়ন এবং শিশু প্রায় ২ মিলিয়ন। ২০০৭ সালে বিশ্বে নতুনভাবে এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ২.৭ মিলিয়ন। এবং মৃতের সংখ্যা প্রায় ২ মিলিয়ন। ১৯৮১ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রাথিবীতে এইডস রোগে মৃতের সংখ্যা প্রায় ২৫ মিলিয়ন।

২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার আর ভারতে প্রায় ২.৪৫ মিলিয়ন। সাব-সাহারান আফ্রিকায় এইডস রোগীর সংখ্যা প্রায় ২২ মিলিয়ন। মধ্য-পূর্ব ও উত্তর আফ্রিকায় প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার জন। অর্থাৎ বিশ্বের ৬৬% এইডস আক্রান্ত রোগীই আফ্রিকায়। বিশ্বে তুলনামূলকভাবে মুসলিম দেশগুলোতে এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আনেক কম। (সূত্রঃ টঘঅওউঝ ২০০৮  ৎবঢ়ড়ৎঃ ড়হ ঃযব মষড়নধষ অওউঝ বঢ়রফবসরপ)

এইডস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য সুচিকিৎসার ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত মানুষের আয়ত্তে আসেনি। তাই এইচ,আই,ভি প্রতিরোধই এইডস থেকে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। কথায় বলে- 'চৎবাবহঃরড়হ রং নবঃঃবৎ ঃযধহ পঁৎব.' অর্থাৎ প্রতিষেধকের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।

এইচ,আই,ভি/ এইডস প্রতিরোধের ক্ষেত্রে নৈতিক তথা ধর্মীয় অনুশাসনাদিই সর্বাপেক্ষা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। বিদায় হজ্বের ভাষণে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছিলেন যে, আমি তোমাদের জন্য দুটো জিনিষ রেখে যাচ্ছি।
(১)    আল-কোরআন ও (২) রাসুলুল্লাহর সুন্নাহ অর্থাৎ আল-হাদীস।
পৃথিবীর যাবতীয় সকল সমস্যার সমাধান একমাত্র কোরআন এবং হাদীস থেকেই নেয়া সম্ভব। কোরআন এবং হাদীস অনুযায়ী চললে কোন সমস্যাই আর সমস্যা থাকে না।

গধহ রং ধ ৎধঃরড়হধষ ধহরসধষ অর্থাৎ মানুষ বিবেকবান প্রানী। কথায় নয় কাজেও মানুষকে এই সত্যটিই প্রমান করতে হবে।

কিভাবে একজন এইচ,আই,ভি ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে? এ প্রশ্নের জবাবে সংক্ষেপে বলা যায়,

(১) এইচ,আই,ভি আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে যৌন মিলনের মাধ্যমে।
(২) এইচ,আই,ভি আছে এমন কারো রক্ত গ্রহনের মাধ্যমে।
(৩) ইনজেকশনের সুঁই/ সিরিজ ভাগাভাগি করার মাধ্যমে।
(৪) এইচ,আই,ভি আক্রান্ত মা থেকে শিশুতে- গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালে বা বুকের দুধ পানের মাধ্যমে।

অর্থাৎ এইচ,আই,ভি ভাইরাস শুধুমাত্র আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের ৪টি তরল পদার্থ যেমনঃ রক্ত, বীর্ষ, যৌনরস ও বুকের দুধ এর মধ্যে থাকে। আবার মানুষের শরীরের বাইরে অন্য কোন প্রানীর শরীরে এইচ,আই,ভি বাস করতে পারে না।

এইচ,আই,ভি ছড়ানোর শর্ত হচ্ছে, আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত, বীর্য, যৌনরস বা বুকের দুধ অন্যের শরীরে যেতে হবে। দৈনন্দিন কাজ বা সামাজিক মেলামেশায় এইচ,আই,ভি ছড়াতে পারে না। এমনকি কোন কীট পতঙ্গের মাধ্যমেও এইচ,আই,ভি ছড়ায় না।

একটু সতর্কভাবে ইসলামী বিধিবিধান মেনে চললেই এইচ,আই,ভি প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেমন ঃ
(১) বিবাহ বহির্ভূত যৌনকাজ থেকে বিরত থাকা।
(২) স্বামী ও স্ত্রী পরস্পর বিশ্বস্ত থাকা।
(৩) ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশা পরিত্যাগ বা সুঁই/ সিরিঞ্জ ভাগাভাগি বন্ধ করা।
(৪) অপরীক্ষিত রক্ত গ্রহণ না করা।
(৫) খাদ্য গ্রহণে ও কাজকর্মে হালাল-হারাম বেছে চলা।
(৬) ব্যভিচার হতে দূরে থাকা। অবৈধ প্রেম ও অপ্রাকৃতিক আচরণ ও সমকামিতা সম্পূর্ণভাবে বর্জন করা।
(৭) কেয়ামত ও শেষ বিচারে বিশ্বাস রাখা।
(৮) বেহেস্তের অফুরন্ত সুখের আশায় এ জীবনে সংযমী হওয়া।
(৯) দোযকের অপরিমেয় দুঃখ হতে পরিত্রাণ পেতে সকল মন্দ ও খারাপ কাজ হতে দূরে থাকা।
(১০) অপরাধকারী তওবা করে ভবিষ্যতে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সুধরে নেয়া।

ইসলাম মানবতার ধর্ম। ইসলাম বৈরাগ্য জীবন স্বীকার করে না। ইসলামের বিধান অনুযায়ী বিবাহের মাধ্যমেই মানব-চরিত্রের কু-প্রবৃত্তি সংশোধন সম্ভব। বিয়ের গুরুত্ব ও পাত্র-পাত্রী সম্পর্কে আল কোরআনের সূরা রুম-এর ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“আর তাঁর নিদের্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও। এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও মমতা সৃষ্টি করেছেন।”

নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন, "নারী পুরুষের বিবাহ আমার সুন্নত। যে ব্যক্তি আমার সুন্নত হতে বিমুখ হবে, সে আমার উম্মতভুক্ত নয়।" (সহীহ বুখারী, কিতাবুন নিকাহ, হাদীস নং-২৪৮৭)

অভিভাবকদের উচিৎ সঠিক বয়সে পুত্র-কন্যাদের বিয়ে দেয়া। সঠিক বয়সে বিয়ে হলে বিবাহ বহির্ভূত যৌনাচারে জড়ানোর সম্ভাবনা অনেকাংশেই কমে যায়। বিবাহ বহির্ভূত যৌনাচার ইসলামে যেমন নিষিদ্ধ তদ্রুপ তা অমান্যকারীর জন্যও রয়েছে পরকালে কঠিন শাস্তি।

সূরা আল আরাফ-এর ৩৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “আল্লাহ হারাম করেছেন সকল প্রকার প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য নিলজ্জ ও পাপ কাজ-কর্ম সমূহ।”

সূরা আল আনআম-এর ১২০নং আয়াতে বলা হয়েছে, “আর তোমরা বর্জন কর প্রকাশ্য পাপ এবং অপ্রকাশ্য পাপও।”
সূরা আন নিসার ৩০নং আয়াতে বলা হয়েছে, “আর যে ব্যক্তি এরূপ কাজ করে, সীমা লঙ্ঘন করে, এবং জুলুম করে তাহলে আমি সত্ত্বরই তাকে দোযখের আগুনে দাখিল করবো। এবং ইহা আল্লাহর পক্ষে সহজ।”

ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চললে খুব সহজেই এইচ,আই,ভি প্রতিরোধ করা যায় । যাদের বিবাহ করার সামর্থ্য বা বয়স হয়নি তাদের উচিৎ যৌনকাজ হতে বিরত থাকা।

এ সম্পর্কে মহানবী (সাঃ) বলেছেন-“যারা বিবাহ করার সমর্থ রাখে না, তাদের কর্তব্য হলো রোজা রাখা।”(বোখারী শরীফ, কিতাবুন নিকাহ, হাদীস নং-৪৬৭৭)

দেহ ও মনে নারী-পুরুষ সকলেরই পর্দা রক্ষা করা উচিৎ। সূরা আন নূর-এর এর ৩০নং আয়াতে বলা হয়েছে-“মুমিনদের বলো তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটিই তাদের জন্য পবিত্রতর ব্যবস্থা।”

যে সব পরিবেশে গেলে কেউ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, সে সব স্পর্শকাতর জায়গা পরিহার করে চলা উচিত। স্ত্রীর সাথে সুসম্পর্ক রাখাকে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। স্ত্রীর মর্যাদা প্রসঙ্গে নবী-করীম (সাঃ) বলেছেন-“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। আর আমি তোমাদের মধ্যে আমার স্ত্রীর নিকট সবচাইতে উত্তম।”(তিরমিযী শরীফ, কিতাবুল মানাক্বিব, হাদীস নং- ৩৮৩০)

তাই স্বামীদের উচিত সর্বাগ্রে স্ত্রীর হক আদায় করা। নিজ পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধি নিয়ে ভাবলে কেউ অন্যদিকে মনোযোগ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। কেয়ামত ও শেষ বিচারকে বিশ্বাসের মাঝে রেখে কোরআন ও হাদীসে উল্লেখিত দোযখের ভয়াবহতা স্বরণ করলে আর কোন সুস্থ মানুষের পক্ষেই অবৈধ কার্য ও পাপ কর্মে সম্পৃক্ত হওয়া সম্ভব নয়।

হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুষ, দম ফুরালেই ঠুস,
তবুতো ভাই কারোরি নাই, একটু খানি হুস।

আমাদের হুস করে চলতে হবে, বলতে হবে। প্রতিটি কাজই করতে হবে হুস করে। তবেই এইডস জাতীয় মারাত্মক সমস্যার সমাধান সম্ভব।

সূরা আল ইমরান-এর ১০৪নং আয়াতে বলা হয়েছে-“তোমাদের মধ্যে এমন একদল থাকা আবশ্যক, যারা কল্যানের আহ্বান জানাবে। ভালো কাজে আদেশ করবে, মন্দ কাজে নিষেধ করবে। তারাই হচ্ছে সফলকাম”।

অর্থাৎ সকলের মধ্য হতে কোরআন ও হাদীসের আলোকে সকল সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই সকলে এ দায়ীত্ব থেকে অব্যাহতি পাবে।

সূরা বনীইসরাঈল-এর ৩২ নং আয়াতে বলা হয়েছে-"তোমরা যেনার ধারে কাছেও যেওনা। এটা অত্যন্ত অশ্লীল ও মন্দপথ।"

এইচ,আই,ভি ছড়ানোর আর একটি আশংকা ও উদ্ধেগের বিষয় মাদকাসক্তি। অনেক তরুণ বিভ্রান্ত হয়ে মাদকের ছোবলে দংশিত হচ্ছে। এসব তরুণরা এইচ,আই,ভি বিস্তারে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছে। বিশেষ করে যারা শিরায় ইনজেকশানের মাধ্যমে নেশা করে। এই ব্যপারটি তাদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এরা এক সিরিঞ্জ একাধিকবার একাধিকজন ব্যবহার করে। এতে এইচ,আই,ভি আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত থেকে খুব সহজেই আর একজনের রক্তে এইচ,আই,ভি ভাইরাস আক্রমন করে।

মাদক বা নেশা গ্রহণ ইসলামে নিষিদ্ধ। মাদক মানুষকে ধ্বংস করে। তাই তরুণদের গভীর মমত্ব ও দরদ দিয়ে আমাদের বোঝাতে হবে। তাদেরকে ইসলামের ছায়াতলে আসার জন্য আহ্বান জানাতে হবে।

মাদক সম্পর্কে সূরা আল বাক্বারাহ-এর ২১৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে-“তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলে দাও-এই দ’ুয়ের মাঝে রয়েছে মহাপাপ আর মানুষের জন্য উপকারিতাও রয়েছে। তবে এর অপকার উপকারিতা থেকে অনেক বেশী ও বিপদজ্জনক।”

মাদক গ্রহনের ক্ষেত্রে এইচ,আই,ভি প্রতিরোধের উপায় হচ্ছে মাদক গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। প্রয়োজনে চিকিৎসা নেয়া এবং সুই বা সিরিঞ্জ ভাগাভাগি সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা। রসুল (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।”  (বুখারী-কিতাবুন নিকাহ, হাদীস নং- ৪৭৮৯)

সুতরাং আসুন আমরা যৌনক্ষেত্রে সংযমী হই এবং মাদক থেকে সম্পূর্ণ বিরত থেকে দায়িত্বশীল আচরণ করি এবং এইচ,আই,ভি প্রতিরোধ করি।

আল্লাহ পাক মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। অন্য যে কোন প্রানীর তুলনায় মানুষের বিবেক, বুদ্ধি, জ্ঞান অনেক বেশী। অথচ যখনই আমরা এইচ,আই,ভি পরিস্থিতির কথা শুনি, তখনই মানুষের অজ্ঞানতার কথা মনে পড়ে যায়। ভাবি-
এত অবুজ শিশু পৃথিবী ভরে,
সকলরে মোরা বোঝাই কেমন করে!

বাংলাদেশে যেমন বিভিন্ন শ্রেণীর পতিতা রয়েছে, তেমনি তাদের হরেক রকম খদ্দেরও রয়েছে।এইচ,আই,ভি ভাইরাসের জন্য উভয়েই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এইচ,আই,ভি প্রতিরোধ করতে হলে সমাজ থেকে পতিতাবৃত্তি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিতে হবে।

সূরা আন নূর-এর ২নং আয়াতে বলা হয়েছে, “ব্যভিচারিনী নারী এবং ব্যভিচারী পুরুষকে ১০০ দোররা লাগাও এবং আল্লাহর বিধান পালনে তাদের উভয়ের প্রতি তোমাদের মনে কণামাত্র দয়া আসা উচিৎ নয়। যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি এবং কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান রাখ, মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।”

এভাবে ব্যভিচারী নারী-পুরুষকে প্রত্যেক্ষভাবে জন সম্মুখে শাস্তি দিলে ভবিষ্যতে অন্য কেউ ব্যভিচার করার সাহস পাবে না। লজ্জিত হবে। আর ব্যভিচার যত কমবে, এইডস ও তত কমবে।
অনেক সময় গরীব মেয়েদের বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধ যৌন কাজে প্রলুব্ধ করা হয়। এই সম্পর্কে আমাদের সন্তানদের সচেতন করা উচিৎ। প্রেম হবে পবিত্র। প্রেমের ক্ষেত্রে-
ওভ ুড়ঁ ঃড়ঁপয, ুড়ঁ ংঁভভবৎ সঁপয.

সূরা মায়েদাহ-এর ৫নং আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা তাদেরকে পতœী করে নাও, প্রকাশ্য ব্যভিচার বা গোপন প্রণয় করো না। যে ব্যক্তি ঈমানের বিষয়ের সাথে কুফর করবে, তার আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে। এবং সে ব্যক্তি পরকালে সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।”

যদি কারো পক্ষে শারীরিক মিলন ছাড়া থাকা সম্ভব না হয়, তবে তার উচিৎ বিবাহ করা। আমাদের সমাজে বিয়েকে সহজ করা উচিত। অনর্থক যৌতুকের কারণে বিয়ে যেন কঠিন না হয়, সে ব্যাপারে আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত।

সূরা আন নূর-এর ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“আর যারা বিবাহ করিতে অসমর্থ তাদের উচিৎ যেন তারা সংযমী হয়ে থাকে।”

এইডস এর আর একটি প্রধান কারণ সমকামীতা। পশ্চীমা দেশগুলো লাইসেন্স দিয়ে সমকামীতাকে সাপোর্ট করছে। নারী-নারী কিংবা পুরুষ-পুরুষ বিবাহ সেখানে বৈধ । তারা পতিতাবৃত্তিকেও বৈধ করেছে। এটা কোন সমস্যার সমাধান নয়। এসব ভুল পদক্ষেপে সমস্যা আরো জটিল থেকে জটিলতর আকার ধারন করেছে।

লূত (আঃ)-এর সময় এ ধরনের অপ্রাকৃতিক আচার-আচারণ, সীমা লঙ্ঘন ও সমকামীতার জন্য সমগ্র জাতি আল্লাহর ঘোর আযাবে পতিত হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে সূরা আশ-শোআরার ১৬৫ থেকে ১৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

“তোমরা কি সমস্ত বিশ্ববাসীর মধ্য হতে পুরুষদের সাথে অপকর্ম করিতেছ ?
 তোমাদের রব তোমাদের জন্য যেই স্ত্রী সকল পয়দা করেছেন, তাদেরকে বর্জন করিতেছ? তোমরা সীমা লংঘনকারী লোক।
তাহারা বলিল হে লূত! তুমি যদি বিরত না থাক, তবে অবশ্যই বহিস্কার করা হবে।
লুত বলিলেন, আমি তোমাদের এই কার্যের প্রতি অত্যন্ত ঘৃণা পোষন করি।
 (তারা মানলো না। আযাবের লক্ষণ পেয়ে লুত (আঃ) দোয়া করলেন।) হে আমার রব! আমাকে এবং আমার সংশ্লিষ্টদেরকে ইহা হতে রক্ষা কর !
সুতরাং আমি তাহাকে ও তাহার সংশ্লিষ্টদের সকলকে রক্ষা করিলাম।
অনন্তর আমি অন্যান্য সকলকেই ধ্বংস করে দিলাম।
আর আমি তাদের উপর এক বিশেষ প্রকারের (প্রস্তর) বৃষ্টি বর্ষন করিলাম; অতএব কি নিকৃষ্ট বৃষ্টি ছিল, যাহা সেই পাপীদের উপর বর্ষিত হইয়াছিল।”

সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস
অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।
জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই অসৎ সঙ্গ ও সকল কুপ্রবৃত্তি ত্যাগ করতে হবে। এই পৃথিবীতে যে যার সঙ্গী হবে, কেয়ামতের দিনেও তাকে সেই দলভুক্ত করা হবে। তাই আসুন,
বুদ্ধিমান হই, ঠিক কাজটি করি।
অসৎ সঙ্গ ও খারাপ কাজ ত্যাগ করে এইডস থেকে দ্রুত পরিত্রান পাই।

কেউ কেউ এইচ,আই,ভি সম্পর্কে বিস্তারিত না জানার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সমাজচ্যুত করা এবং মৃত্যুর পর দাফন-কাফন ও জানাযা করা যাবে না। এমন মত প্রকাশ করতে পারে। আমাদেরকে এসব বিষয়ে খুব সাবধানী হতে হবে। কারণ আমরা জানি না তিনি কিভাবে এ রোগে আক্রান্ত হলেন।

সূরা আল হুজরাত-এর ১১ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “হে মুমিনগন! পুরুষরা যেন অপর পুরুষকে উপহাস না করে, হতে পারে উপহাসকৃতরা উপহাসকারীর চাইতে উত্তম। তাছাড়া নারীরা যেন অপর নারীদেরকে উপহাস না করে। হতে পারে উপহাসকৃতরা উপহাসকারীর চাইতে উত্তম। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না। তোমরা এক অপরকে মন্দ নামে ডেকোনা।”

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করলেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেন:
“মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে না তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, না তাকে মিথ্যা বলতে পারে। না তাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারে। বস্তুত: প্রত্যেক  মুসলমানের মান-ইজ্জত, ধন-সম্পদ, ও রক্ত অন্য সব মুসলমানের উপর হারাম। (তিনি বক্ষস্থলের দিকে ইশারা করে বললেন) তাকওয়া এখানে আছে।”

কোন ব্যক্তির খারাপ হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, তার মুসলমান ভাই তাকে ঘৃণা করে। হেয় প্রতিপন্ন করে। (সহীহ তিরমিযি, কিতাবুল বিরবি, ওয়াসসিলাহী, হাদীস নং -১৮৫০)

উপরের আয়াত ও হাদীস হতে এটা স্পষ্ট যে, কোন মুসলমানের সম্মান রক্ষা করা অপর মুসলমানের কর্তব্য ও দায়িত্ব। কাউকে উপহাস করা, কারো সম্পর্কে সন্দেহ করা নিন্দা করা ইত্যাদি ইসলামে নিষিদ্ধ।

আমাদের উচিৎ এইচ,আই,ভি বা এইডস আক্রান্ত ভাইবোনদের খোঁজ-খবর নেয়া। বিশেষ করে যখন তারা অসুস্থ হয়ে যায়। অসুস্থ লোকের খোঁজ নেয়া ইসলামের বড় সওয়াবের কাজ। হাদীসে কুদসীতে বর্নিত আছে- আল্লাহ কিয়ামতের দিন বলবেন, "হে আমার বান্দা, আমি অসুস্থ ছিলাম, তুমি আমার খোঁজ নাওনি। তখন বান্দা বলবে, হে আল্লাহ তুমি কিভাবে অসুস্থ হতে পারো, তখন আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিলো, তার খোঁজ নিলেই আমার খোঁজ নেয়া হতো।” (মুসলিম শরীফ, হাদীস নং-৪৬৬১)

রসূল (সাঃ) বলেছেন, “পৃথিবীবাসীর প্রতি দয়া করো, তাহলে আকাশবাসীরা তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।” (তিরমিযি শরীফ)

নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না।” (সহীহ বুখারী, কিতাবুল আদাব, হাদীস নং-৫৫৩৮)

অতএব রোগাক্রান্ত সকল ভাই-বোনদের প্রতি আমাদের সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও মমত্ববোধকে প্রসারিত করতে হবে।রোগীকে দেখতে যাওয়ার প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “কোন মুসলিম যতক্ষন কোন মুসলিম ভাইয়ের সেবা শুশ্র“ষায় রত থাকে এবং যতক্ষন পর্যন্ত সে ফিরে না আসে, ততক্ষন সে জান্নাতের নেয়ামতরাজিতে অবস্থান করতে থাকে। প্রশ্ন করা হলো, জান্নাতের নিয়ামতরাজি কি? তিনি বললেন, এটি হলো জান্নাতের ফলসমূহ।” (মুসলিম, হাদীস নং- ৪৬৬০)

আমরা সকলে নিশ্চয়ই একমত হবো যে, পৃথিবী ব্যাপী এ মানবিক বিপর্যয়ে আমরা বসে থাকতে পারি না। আমাদের এ বিপর্যয়ে যেমন প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে। তেমনি আক্রান্ত ব্যক্তিদের সহযোগীতায় এগিয়ে আসতে হবে। আমরা যদি উদার মনে এগিয়ে আসি, তাহলে একটি ইতিবাচক পরিবেশ ও সুখী সমাজ তৈরী হবে। এইচ,আই,ভি ও এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিরা মানসিক শক্তি পাবে।
সূরা আল হাশরের ১০ নম্বর আয়াতের ন্যায় আমরা আল কোরআনের ভাষায় প্রার্থনা করি, “হে আমাদের রব! আমাদের অন্তরে মুমিনদের প্রতি ঘৃণা ও আক্রোশ সৃষ্টি করো না।”

আমরা যদি ইসলামের মহানুভবতার মহান আদর্শ সমাজে তুলে ধরতে পারি, নিজেরা যথাযথভাবে তার চর্চা করি, তাহলে এইডসসহ যে কোন সমস্যাকে ইনশাআল্লাহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো।
ইসলাম শুধু ধর্মাচার নয়, বরং এটি মানুষের পার্থিব কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে একটি পূনাঙ্গ ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন বিধান। মানব জীবনের যাবতীয় সমস্যাবলীর সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাধান ইসলামী জীবনদর্শনে রয়েছে বলেই ইসলামকে বলা হয়, ‘অ পড়সঢ়ষবঃব পড়ফব ড়ভ ষরভব. দ

বিপথগামী মানুষকে সঠিক পথের দিশা দিতে যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল এই পৃথিবীতে এসেছেন। জাহান্নামগামী মানুষদের জান্নাতের দিকে ডেকেছেন। অবিশ্বাসী ও অপরাধীদেরকে বিশ্বাসী এবং পবিত্র জীবন-যাপনে ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বাতœক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আইয়ামে জাহেলিয়াতের অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষদেরকে আলোর পথে ডেকেছেন।

এ প্রসঙ্গে সূরা আল ইমরানের ১০৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা একটি অগ্নিকুন্ডের পাশে দাঁড়িয়েছিলে, আল্লাহ তোমাদেরকে সেই অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করলেন।”
ইসলাম মানুষকে সুন্দর আচরণে ভূষিত হওয়ার আহবান জানায়। তাই ব্যক্তি ও সমাজে যা কিছুই স্বাস্থের জন্য হুমকি ও ক্ষতিস্বরূপ, সবই ইসলাম নিষিদ্ধ বিবেচনা করে।

এ প্রসঙ্গে সূরা আল্ বাক্কারাহ্ এর ১৯৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা তোমাদের হাতগুলো ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।”

আমাদের সবার উচিৎ ইসলামের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে পথ চলা। জীবনের যা কিছু মন্দ, যা কিছু খারাপ করেছি বিবেকের গোচরে বা অগোচরে সবকিছুর জন্য খাস দিলে তওবা করে নিজেকে আবারো শুধরে নেয়া আমাদের কর্তব্য।

সূরা মারইয়াম এর ৬০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, "যারা তওবা করেছে এবং ঈমান আনয়ন করেছে ও নেক কাজ করেছে, বস্তুত: তারা বেহেস্তে যাবে। এবং তাদের বিন্দুমাত্রও ক্ষতি করা হবে না।

এইডস এ আক্রান্ত ভাই-বোনদের উচিৎ খুব দ্রুত আল্লাহর দরবারে তওবা করে নেয়া। যে মৃত্যু পথযাত্রী, তওবাতে তার মৃত্যু যন্ত্রণা কমে যাবে ইনশাল্লাহ। যে গুরুতর অসুস্থ তার অসুস্থতা কমবে।আল্লাহর রহমতে পুরোপুরি সেরেও যেতে পারে। আর পরকালের মুক্তিতো আছেই।

রাসুল (সাঃ) বলেছেন, মানুষের গুনাহ পাহাড় সমান হলে আল্লাহর ক্ষমা তার চেয়েও বেশী। অতএব কেউ যদি ব্যক্তিগত দোষের কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তাকে আল্লাহর কাছে খাস দিলে শুদ্ধ নিয়তে ক্ষমা চাইতে হবে। তওবা যথাযথ হলে আল্লাহ সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন ইনশাল্লাহ।
ভুল মানবীয়, ক্ষমা স্বর্গীয়।

মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়। তবে এই ভুলকে সংশোধন করে আমাদেরকে সঠিক পথে চলতে হবে।
সূরা আল-আনআম এর আয়াত নং-৫৪ তে বলা হয়েছেÑ“যারা আমার আয়াত সমূহের উপর ঈমান এনেছে তারা যখন তোমার কাছে আসবে, তখন তুমি তাদের বলো, আল্লাহতা’য়ালার পক্ষ থেকে তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তোমাদের উপর অনুগ্রহ করাটাকে আল্লাহতা’য়ালা নিজের উপর কর্তব্য বলে স্থির করে নিয়েছেন। তবে তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কখনো অজ্ঞানতাবশত কোন অন্যায় কাজ করে বসে এবং পরক্ষণেই তওবা করে ও নিজের জীবনকে শুধরে নেয়, তাহলে আল্লাহতা’য়ালা একান্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।”

সূরা নিসার আয়াত নং ১৬ তে বলা হয়েছে, “আর যে কোন দুই ব্যক্তিই তোমাদের মধ্য হতে এই নির্লজ্জতার কাজ করবে, তবে তাহাদিগকে কষ্ট প্রদান কর, অনন্তর যদি তাহারা তওবা করে এবং সংশোধন করে নেয়, তাহলে তাদের পিছনে লেগে থেকো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তওবা কবুলকারী করুনাময়।”

অতএব আমরা যদি বুঝতে পারি যে, কেউ ভুলের মাঝে পতিত হয়েছে, আমাদের কর্তব্য হলো তাকে সাহায্য করা, ঘৃনা করা নয়। যাতে সে ভুল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, সে ব্যাপারে উদ্দ্যোগী হওয়া। আমরা তাকে আল্লাহর পথে চলতে সাহায্য করতে পারি। আমাদের নিরাশ হবার কিছুই নেই। খাস দিলে তওবা করলে মহান করুনাময় আল্লাহতা’য়ালা আমাদের ক্ষমা করবেন ইনশাল্লাহ।

'দশে মিলে করি কাজ,
হারি জিতি নাহি লাজ।' 
আসুন আমরা সবাই ইসলামের ছায়াতলে এসে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এইচ,আই,ভি ও এইডস সহ যাবতীয় সমস্যার সমাধানকল্পে কাজ করে যাই।
আল্লাহ আমাদের সবচাইতে সঠিক ও সরল পথে পথ চলার তৈফিক দান করুন। আমীন।

প্রকাশ ঃ দৈনিক ইনকিলাব, (ইসলামী জীবন), ৫, ১০ আগষ্ট, ২০০৮ইং।  
    ৬, ৮, ১০,১৩ ডিসেম্বর, ২০০৯ইং।

বইয়ের নামঃ ফী ত্বলাবুল জান্নাত (জান্নাতের খোঁজে)
লেখক ঃ খন্দকার নাজনীন সুলতানা

৩. সংসার সাজাতে স্বামী ও স্ত্রীর ভূমিকা- ইসলামের আলোকে

বিয়ের মাধ্যমেই একটি ছেলে ও মেয়ের সাংসারিক বন্ধনের সূত্রপাত। বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলেরা মেয়েদের হরেক রকম গুনের খোঁজ করে। ভাবে রুপে ক্লিওপেট্রা, গুনে লক্ষ্মী, বিদ্যার স্বরস্বতী- এমন কনে যদি পাই, তবেই বিয়ে করি। তাকি আর সম্ভব?

তাই বিবাহের পূর্বে কণে নির্বাচনের সময় পাত্রকে ধরে নিতে হবে যে, কণের সর্বগুণ এক সাথে পাওয়া সম্ভব নয়। পৃথিবীর এক এক মেয়ে এক এক গুনে গুনান্বিতা, পাত্রীর কোন গুনটিকে পাত্র অগ্রাধিকার দেবেন, সে দ্বায়িত্ব তার নিজের।

পাত্রী নির্বাচনের বিষয়ে হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্নিত একটি হাদীসে আমরা পাই, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন- “মেয়েদেরকে সাধারনত চারটি বিষয় দেখে বিয়ে করা হয়। তার সম্পদ দেখে, বংশ মর্যাদা দেখে, রুপ-সৌন্দর্য দেখে এবং তার দ্বীনদারী দেখে। তবে তোমরা দ্বীনদারী মেয়ে লাভ করার চেষ্টা কর, তোমাদের কল্যান হবে।”  (বুখারী, মুসলিম)

ধরুন, স্বামী অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষন, তাই দেখে শুনে দ্বীনদারী মেয়েকেই স্ত্রী হিসাবে গ্রহন করলেন। এখন আপনার সংসারে নববধুর ভূমিকা এবং দায়-দায়ীত্ব কি হবে তা স্বামীর উপরেই নির্ভর করে।

নববধু মেয়েটি তার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমস্ত পরিচিত জনদের ছেড়ে, সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে, নতুন মানুষদের মাঝে স্বামীর সংসার করতে আসে। তার কাছ থেকে সাংসারিক কাজকর্মে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ মা কিংবা খালার মত পারদর্শিতাতো আর আশা করা যায় না। নববধুকে নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেবার সুযোগ দিতে হবে। সাংসারিক সব কাজ শেখার প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে।


সূরা বাক্বারার ২২৮ নম্বর আয়াতে আছে-
"পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের উপর অধিকার রয়েছে, তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েচে পুরুষদের উপর নিয়ম অনুযায়ী। আর নারীদের উপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে।"

আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, বিজ্ঞ। তাই নারীদের উপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেছেন। তাই বলে নারীরা একেবারেই অবহেলার পাত্র হবে তা তো নয়। তার পছন্দ-অপছন্দ, ভালো-মন্দ, চাওয়া-পাওয়ার মূল্যায়নতো করতেই হবে। নারী, সেও তো একজন মানুষ, মানবিক অধিকার গুলো অবশ্যই তার কাম্য। আর বিজ্ঞ স্বামী হিসাবে আপনার ভূমিকা ও দায়-দায়ীত্ব কি হবে, তা স্বামীকে অবশ্যই বুঝতে হবে।

সংসারকে সুন্দর ও সুষমামন্ডিত করার সমস্ত দায়-দায়ীত্ব যদি নববধুর উপর চাপিয়ে দেয়া হয়, তবে তা কি ইনসাফ হয়? বিজ্ঞ স্বামী, সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে বা গোসল করে, নাস্তা শেষে চলে গেলেন অফিসে বা আপন কর্মক্ষেত্রে। ফিরে এলেন রাত বারোটা, একটায়। নববধু সারাদিন ঘরে একা একা কি করবেন? ধার্মীক নববধু হয়তো নতুন সংসারের টুক টাক কাজ কর্ম সেরে বসে বসে নামাজ পড়লেন। আর দোয়া-দুরুদ পড়ে পড়ে কান্নাকাটি করলেন। এভাবে কয়দিন চলবে? নিঃসঙ্গ, একাকী থাকতে থাকতে একদিন নববধু হয়ে যাবেন মানষিকভাবে ভারসাম্যহীন, পাগোল, তখন স্বামীর সংসারকে সুন্দর আর সুষমামন্ডিত করবে কে?

বিজ্ঞ স্বামী স্ত্রীর মন খারাপ আর কান্নাকাটি দেখে ভাবলেন, থাক কিছুদিন অফিসে যাব না। এই ভেবে দুই-তিন মাস একাধারে বাসায় বসে রইলেন। এতে আপনার চাকরীটা যাই যাই করবে, বা চলেই যাবে। আর ব্যবসায়ী হলে ব্যবসার জ্বলবে লাল বাতি।

স্বামীকে হতে হবে দৈহিক ও মানষিকভাবে সুস্থ্য এবং স্বাভাবিক। কাজও করবেন, স্ত্রীকেও সময় দিবেন। ছুটির দিনগুলোতে ঘরে বিশেষ কোন কাজ না থাকলে বেড়িয়ে পরতে পারেন মনোরম সুন্দর আকর্ষনীয় কোন স্থানে কিংবা যেতে পারেন কোন বন্ধু-বান্ধবের বাসায়। এতে মনও প্রফুল্ল হবে, সামাজিকতাও রক্ষা পাবে। অজুহাত দেখাবেন না যে, সময় নেই, ব্যস্ত, কারণ যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে। যে পারে সবই পারে, আর যে পারে না সে কিছুই পারে না।

সূরা আন নিসার প্রথম আয়াতে আছে-
“হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন। আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগনিত পুরুষ ও নারী।”

 আল্লাহ প্রথমে হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করলেন, তারপর সৃষ্টি করেন বিবি হাওয়া (রাঃ) কে। তাই নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেন-“নারীকে বাঁকা হাড় হতে তৈরী করা হয়েছে যদি সোজা কর ভেঙ্গে যাবে। এজন্য ভালোবাসার আচরণ কর, তাহলে জীবন নির্বাহ হবে।”   (ইবনে হিরান)

সূরা রুম-এর ২১ নম্বর আয়াতে আছে-
“আল্লাহ তা’আলার একটি বড় নিদর্শন হল, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন। যেন তোমরা তাদের কাছে গিয়ে আরাম বোধ কর। অধিকন্তু, তিনি উভয়ের মাঝে সৃষ্টি করেছেন ভালবাসা ও সহমর্মিতা।”

স্ত্রী এবং স্বামী উভয়েরই কখনও কারো মনে কষ্ট দেয়া উচিৎ নয়। এ সম্পর্কে একটি হাদীস উল্লেখ করা যায়।সাহাবী হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেন- “যখন কোন মহিলা তার স্বামীকে কষ্ট দেয়, তখন আল্লাহ তা’লার পক্ষ থেকে স্বামীদের স্ত্রীরুপে নির্ধারিত বেহেশতের ডাগরচোখা রমনীগণ দুনিয়ার স্ত্রীদেরকে লক্ষ করে বলতে থাকে, তুমি একে কষ্ট দিও না, কারণ এতো তোমাদের কাছে কয়েকদিনের মেহমান মাত্র। এবং খুব শীঘ্রই সে তোমাদের ছেড়ে আমাদের কাছে চলে আসবে।”

নবী করীম (সাঃ) ছিলেন পৃথিবীর সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বামী। তিনি তাঁর স্ত্রীদের সাথে অত্যন্ত ভালো ব্যবহার করতেন। এ সম্পর্কে হুযুর করীম (সাঃ) বলেছেন-“তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক ভালো মানুষ তারাই যারা তাদের স্ত্রীদের সাথে ভাল ব্যবহার করে। আর আমি তোমাদের মধ্যে আমার স্ত্রীদের সাথে সবচেয়ে ভালো আচরণকারী।”

সূরা বাক্বারার ১৮৭ নম্বর আয়াতে আছে-“তারা তোমাদের জন্য পোশাক এবং তোমরাও তাদের জন্য পোশাক।” অর্থাৎ স্ত্রীরা স্বামীদের ভুষণ এবং স্বামীরাও স্ত্রীদের ভূষণ। একে অন্যের পরিপূরক।

‘মিলে মিশে করি কাজ, হারি-জিতি নাহি লাজ’। সংসারের যে কোন কর্মকান্ডে স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই দু’জনার মতামতের মূল্য দিতে হবে। নারীদের উপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে, তাই শ্রেষ্ঠ স্বামী যদি জোর পূর্বক তার মতামত বা সিদ্ধান্তকে অসহায় স্ত্রীর উপর চাপিয়ে দেন, তবে স্ত্রী বেচারী তো ধীরে ধীরে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে, তাই নয় কি? একজন অসুস্থ স্ত্রী কী তখন গড়তে পারবেন, মনের মতো সুন্দর ভালোবাসার সংসার ? তাই স্ত্রীকে সুস্থ রাখার দায়ীত্ব বিজ্ঞ স্বামীরই।

হুযুরে আকরাম (সাঃ) এরশাদ করেন-“স্ত্রীর উপর হঠাৎ অসন্তুষ্ট হয়ো না, যদি তার একটি স্বভাব অপছন্দ হয়, তবে অন্যটি পছন্দনীয় হবে।” (মুসলিম)

রাসূলে করীম (সাঃ) এরশাদ করেন-“নেককার স্ত্রী-যে স্ত্রী ঈমানের সাহায্যকারী, সে একজন মুসলমানের জন্য পরম সম্পদ।”

স্ত্রী যদি নেককার হয়, তবে সে অবশ্যই বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন হবে। সেক্ষেত্রে স্ত্রীর কোন আচরণ, ব্যবহার বা কাজ যদি স্বামীর পছন্দ না হয়, তবে বিজ্ঞ স্বামী রাগারাগি না করে স্ত্রীকে বুঝিয়ে বললেই পারেন, ভালো ব্যবহার আর আদরেতো বনের পশুও পোষ মেনে যায়। আর স্ত্রীতো রক্ত মাংসের মানুষ।

রাসূলে আকরাম (সাঃ) এরশাদ করেন- "কোন মুমিন ব্যক্তির জন্য পরহেজগারীর পর নেককার স্ত্রী অপেক্ষা উত্তম কোন সম্পদ নেই।
নেক স্ত্রীর লক্ষন গুলো হলো -
(১) যখন তাকে কোন নির্দেশ দেয়া হয়, তা সে পালন করে।
(২) স্বামী যখন তার মুখের দিকে তাকায়, তখন সে স্বামীকে আনন্দ দান করে।
(৩) যদি তাকে কোন শপথ দেয়া হয়, তবে সে তা পূরণ করে।
(৪) স্বামী যদি কখনও বিদেশে চলে যায়, তবে স্বামীর অনুপস্থিতে সে নিজের সতীত্ব ও স্বামীর ধন-সম্পদ রক্ষা করে।"  (ইবনে মাজা)

সারল্য নারীর সৌন্দর্য, নারীরা হবে- সহজ, সরল এটাই স্বাভাবিক। অযথা এবং অকারণে স্ত্রীদের সন্দেহ করা উচিৎ নয়। সঠিক জিনিস না জেনে শুধু মাত্র সন্দেহ বা অনুমানের উপর স্ত্রীর সাথে খারাপ আচরণ করা অমানবিক।

এ সম্পর্কে সূরা নূর-এর ২৩ নম্বর আয়াতে আছে-“যারা সতী-সাধধী, সরলমনা ও বিশ্বাসী নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারা দুনিয়া ও আখেরাতে অভিশপ্ত। এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।”

অনেক স্বামী আছে যারা স্ত্রীকে মেরে ধরে নিজের কতৃত্ব জাহির করতে চায়। অবলা অসহায় স্ত্রীকে মেরে এরা অনুুতপ্ততো হয়ইনা বরংচ ভাবে, এটা তাদের ক্ষমতা ও বাহাদুরীর বহিঃপ্রকাশ এবং স্ত্রীর উপর স্বামীত্ব ফলানো হচ্ছে। অকারণে বা সামান্য কারণে স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা জঘন্য অপরাধ। স্বামীর অত্যন্ত নীচু স্বভাবের পরিচয়।
কথায় আছে-‘দরবারে জিততে না পারলে ঘরে এসে বৌ কিলায়’। স্ত্রীর সাথে এমনটি করবেন না।

হযরত আয়শা (রাঃ) বলেন- “প্রিয় নবী (সাঃ) সারা জীবনে কখনই কোন স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেননি। এবং যখনই তিনি ঘরে প্রবেশ করতেন, তাঁর মুখশ্রী থাকতো ইষৎ হাস্যভায় স্নিগ্ধময়।”

সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতে আছে-
“পুরুষরা নারীদের উপর কৃতৃত্বশীল এজন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। এবং এজন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সেমতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগত এবং আল্লাহ যা হেফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাযত করে।”

একজন সৎ ও আদর্শ স্ত্রীকে অবশ্যই তার স্বামীর সব কথা মেনে চলতে হবে। অবশ্য তা যদি ইসলাম বিরোধী না হয়। কারণ আল্লাহ এবং রাসূলের আদেশ নিষেধ পালন, নারী-পুরুষ, স্বামী-স্ত্রী, নির্বিশেষে সকলেরই প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য। স্ত্রীর কাছে স্বামীর মূল্য অনেক অনেক বেশী। তবে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সম্মান ও মূল্যের চেয়ে বেশী নয়। নারীর হেফাযতযোগ্য সম্পদ তার সতীত্ব। নারীর জন্য এর চেয়ে মূল্যবান সম্পদ আর নেই। আজন্ম সাধনা আর সংগ্রাম করে হলেও এ সম্পদ নারীকে রক্ষা করতেই হবে।

বর্তমানে অত্যাধুনিক যুগে, অনেক স্বামী আছেন যারা ঘরে দশ থেকে বিশ বৎসরের কাজের মেয়ে রাখেন এবং স্ত্রীর সম্মুখে বা অগোচরে এদের দ্বারা হাত-পা টেপাতে ও শরীর ম্যাসেজ করাতে ভীষন উৎসাহ বোধ করেন। স্ত্রী বাধা দিতে এলে স্ত্রীর উপর চলে অকথ্য গালিগালাজ ক্ষেত্র বিশেষে মারধর।
“লোক সমাজের দৃষ্টিতে যা ঘৃণিত, তাই পাপ।”এসব স্বামী পাপ-পূর্ণের তফাৎ বোঝেন না। কিংবা বুঝেও না বোঝার ভান করেন। যে বুঝে না তাকে বোঝানো যায়। কিন্তু যে বুঝেও না বোঝার ভান করে তাকে বোঝানো কঠিন।

বনী ইসরাঈলের ৩২ নম্বর আয়াতে আছে-“তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়োনা। নিশ্চই এটা অশ্লীল কাজ এবং অসৎ পন্থা।”

সূরা আনআম এর ১৫১ নম্বর আয়াতে আছে-“লজ্জাহীনতার যত পন্থা আছে তার নিকটেও যেয়ো না। তা প্রকাশ্যেই হউক আর গোপনেই হউক।”

স্বামী-স্ত্রী তথা নারী-পুরুষ সকলকেই ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে সম্মান ও শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার্থে এবং দৈহিক-মানবিক প্রশান্তির লক্ষ্যে সকল প্রকার ব্যভিচার ও লজ্জাহীনতার কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। ব্যভিচার, অশ্লীল কাজ, অসৎ পন্থা আর লজ্জাহীনতার কাজ যত গোপনেই করা হোক না কেন, কেউ না দেখুক স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তো দেখছেনই। তাই আল্লাহকে ভয় করতে হবে। আল্লাহ আল আদলু- ন্যায় বিচারক, আল হালিমু- মহা ধৈর্যশীল।

আল্লাহ এই পৃথিবী নামক পরীক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের সব কিছুই অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে লক্ষ্য করে যাচ্ছেন। দুনিয়াতেও কেউ কেউ অশান্তি নামক সাময়িক শাস্তিতে পতিত হচ্ছেন। আর পরকাল ও আখেরাতে আছে চরম শাস্তি। এখনও সময় আছে তওবা করে নিজেকে সংশোধন করে নিন। আল্লাহ আল গাফফারু- মহা ক্ষমাশীল, ন্যায় বিচারক। তাই ন্যায়-অন্যায় ভালো-মন্দ সবকিছুর ন্যায়সম্মত ও সর্বাপেক্ষা সঠিক বিচার কেয়ামত ও হাশরের মাঠে একদিন হবেই হবে।

ইসলাম অর্থ শান্তি। তাই যে বা যারা যতবেশী ইসলামের নিয়ম-নীতির মাঝে থাকতে পারবেন, তিনি বা তারা তত বেশী সুখ ও শান্তির অধিকারী হবেন।

সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে
যদি স্বামী-স্ত্রী দ’ুজনারই পরকালের ভয় থাকে আপন মনে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন- ‘স্ত্রী লোকের বেহেশত এবং দোযখ বলতে তার স্বামী।’  (আহমদ নাসাঈ) । ঠিক তাই। স্বামী-স্ত্রীর মিল মহব্বত থাকলে সে গৃহে স্বর্গের সুশীতল বাতাস বইতে থাকে। আর অমিল থাকলে তা নরকের যন্ত্রনার চেয়েও অধিকতর যন্ত্রনাদায়ক মনে হয়।

রসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন-“আল্লাহ তা’আলার নিকট সেই স্বামী-স্ত্রীই মর্যাদার দিক থেকে নিকৃষ্টতর যারা একে অন্যের নিকট গমন করে, অথচ পরে পরস্পরের গোপন রহস্য অন্যের নিকট প্রকাশ করে।   (মুসলিম, আবু দাউদ)

রাসূলে আকরাম (সাঃ) এরশাদ করেন, যে স্ত্রীলোক স্বামীর বিনা অনুমতিতে ঘরের বাইরে পা বাড়ায়, সে যতক্ষন ঘরে প্রত্যাবর্তন না করে, ততক্ষন পর্যন্ত সমস্ত ফেরেস্তারা তার উপর অভিসম্পাত করতে থাকেন।  (তাবারানী)

অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর গোপন কথা, আচরণ এসব বাইরে প্রকাশ করা একেবারেই অনুচিত। যারা এরুপ করে বুঝতে হবে তারা বিকৃত রুচি ও মন-মানষিকতা সম্পন্ন।

ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের চুক্তিতে স্বামী পক্ষের শপথ হলো, ‘আমি আমার স্ত্রীর (১) খোরাক (২) পোশাক (৩) বাসস্থানের দায়িত্বভার এবং (৪) স্ত্রীর ইজ্জ্বত, আবরু হেফাজতের দায়িত্বভার গ্রহণ করছি (৫) স্ত্রীর সাথে যাবজ্জীবন সদ্ধ্যবহার করার অঙ্গীকার করছি।

স্বামীর উপর স্ত্রীর কি কি অধিকার রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি বললেন, “স্ত্রীর অধিকার হলো- যখন স্বামী খাবে, তখন তাকেও খাওয়াবে। স্বামী যখন যে মানের কাপড় পরবে, তখন স্ত্রীকেও সে মানের কাপড় পরাবে। স্ত্রীর মুখে আঘাত করবেনা। অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করবে না। গৃহ ব্যতীত অন্য কোথাও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করবে না।”  (আবু দাউদ)

হযরত আবু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনÑ “পরকালের ছওয়াবের নিয়তে যখন কোন ব্যক্তি আপন পরিবার-পরিজনের প্রয়োজনে ব্যয় করে, তখন তা তার জন্য সদকা স্বরুপ হয়।” (বুখারী শরীফ)

অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তায় সদকা বা দান করে যেভাবে মানুষ ছওয়াবের অধিকারী হয়, স্বামী নেক নিয়তে স্ত্রী ও পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণ ও প্রয়োজনীয় সকল ব্যয় করেও অনুরুপ ছওয়াবের অধিকারী হতে পারবে।

ইসলামে স্ত্রীর দায়িত্ব- সন্তান লালন-পালন, সুশিক্ষা দান, শশুড়-শাশুড়ী এবং পরিবারের অন্যান্যদের সাধ্যমত সেবা-যতœ করা। অর্থাৎ ঘরের দায়ীত্ব স্ত্রীর আর বাইরের দায়ীত্ব স্বামীর। তাই স্বামীর বর্তমানে স্ত্রীর জন্য ঘরের বাইরে যাবার কোন প্রয়োজন নেই। তার পরেও কোন বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলে স্বামীর অনুমতি নিয়েই ঘরের বাইরে যেতে হবে। অন্যথায় পাপ হবে।

হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন- “যে মহিলা পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিত আদায় করবে, রমযানে রোযা রাখবে, নিজের ইজ্জত আবরুর হেফাজত করবে, এবং স্বামীর অনুগত থাকবে, বেহেশতের যে কোন দরজা দিয়ে প্রবেশ করার অধিকার তার থাকবে।”  (মিশকাত)

হযরত উম্মে সালমাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আর একটি হাদীসে পাই, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- “যে মহিলা স্বামীকে সন্তুষ্ট রেখে মৃত্যু বরণ করে, সে অনায়াসে বেহেশতে প্রবেশ করবে।”  (তিরমিযী)

অর্থাৎ স্ত্রীর জন্য স্বামীর সন্তুষ্টিই বড় সন্তুষ্টি। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সন্তুষ্টি থাকলে, আল্লাহও সন্তুষ্ট। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যদি এলার্জি না থাকে এবং স্বামী যদি স্ত্রীকে ইসলাম বিরোধী কোন কাজ করতে না বলেন, তবে স্ত্রীর অবশ্যই উচিৎ স্বামীর অনুগত হয়ে থাকা। এতে সংসার সুখের হবে, স্বামীর মনও পাওয়া যাবে। অতি কাঙ্খিত বেহেশতে যাওয়াও সহজ হবে।

স্বামীকেও স্ত্রীর প্রতি হতে হবে সহনশীল। সূরা নিসার ৪নং আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে স্ত্রীগণকে তাদের প্রাপ্য মোহর দিয়ে দাও।” দেনমোহরের হকদার হচ্ছেন স্ত্রী। বর্তমানে আমাদের দেশে স্ত্রীকে দেনমোহরতো দেনইনা বরংচ পাত্রপক্ষ কণে পক্ষের কাছে গহনা, নগদ টাকা, আসবাবপত্র আরো বিভিন্ন রকমের যৌতুক দাবী করেন। যৌতুক চাওয়া আইনত নিষিদ্ধ বলে এখন যৌতুকের নামকরণ হয়েছে ‘সম্মানী’। স্ত্রী পক্ষ থেকে স্বামী পক্ষের জন্য সম্মানী কিংবা উপহার।

রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মোহর ধার্য করে কোন মেয়েকে এই নিয়তে বিয়ে করে যে, উক্ত মোহর দিবে না, সে ব্যভিচারী। আর যে ব্যক্তি কোন ঋণ এই নিয়তে গ্রহন করে যে তা শোধ করবে না, সে চোর।”

উকবা ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্নিত, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন- “মোহরের মধ্যে সেই পরিমান মোহরই উত্তম, যা আদায় করা সহজ সাধ্য।  (নায়লুল আওতার)

অবলা নারী, অসহায় স্ত্রীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়। মোহর পাত্রের সামর্থ অনুযায়ী নির্ধারন করা উচিৎ। এবং বিয়ের সাথে সাথেই স্ত্রীর মোহরানা শোধ করে দেয়া উচিৎ।
এ সম্পর্কে সূরা নিসার ২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “তাদের মোহর তাদেরকে ফরয হিসাবে দাও।”

স্বামী সে বাইরে যতই ভালো হোক না কেন, সে যদি ঘরে তার স্ত্রী ও পরিবার পরিজনের কাছে ভালো না হয়, তবে সে প্রকৃত ভালো হিসাবে গণ্য হবে না।

এ প্রসঙ্গে দুটি হাদীস উল্লেখ করা যায়,
(১) হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন- “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে উত্তম, যে তার পরিবার-পরিজনের নিকট উত্তম। আমি আমার পরিজনের কাছে তোমাদের সকলের চেয়ে উত্তম।   (তিরমিযী, দারেমী)

(২) হযরত আয়শা (রাঃ) হতে বর্নিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- "পূর্ণ মুমিন সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র উত্তম। এবং সে তার পরিবার-পরিজনের (স্ত্রী-পুত্রদের) প্রতি সদয়।"  (তিরমিযী)

স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যখন উত্তম চরিত্রের অধিকারী হবেন, তখন এই পৃথিবীর ছোট সংসারটিই সুখের স্বর্গরাজ্য হয়ে যাবে। সুখ পাখির পিছে প্রাণপণ ছুটতে হবেনা। সুখ পাখিটি আপনা আপনিই এসে স্বামী-স্ত্রীর ছোট্ট ঘরে চিরস্থায়ী বাসা বানাবে, তখন আর হতাশা ও দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে গাইতে হবে না-
'সুখ তুমি কি? বড় জানতে ইচ্ছে করে।’

হুযুর (সাঃ) বলেছেন, কুরাইশ মহিলাদের মধ্যে তারাই উত্তম, যারা নিজেদের শিশু সন্তানদের প্রতি অধিকতর স্নেহশীলা এবং স্বামীর সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণকারিণী।  (বুখারী শরীফ)

বর্তমান যুগের কোন কোন স্ত্রীরা স্বামীর সংসারের কাজ করতে অপমানিত বোধ করেন। অথচ দোজাহানের বাদশাহ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)- এর অতি আদরের কন্যা ফাতেমা (রাঃ) স্বামীর সংসারে যাঁতা ঘুরাতে ঘুরাতে হাতে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল।

স্বামীর আর্থিক সামর্থ থাকলে স্ত্রীকে সাহায্য-সহযোগীতার জন্য গৃহ পরিচারিকা রাখা উচিৎ। অন্যথায় নিজেই ঘরের কাজে স্ত্রীকে সহযোগীতা করা কর্তব্য। এতেও দোষের কিছু নেই। কারণ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে পরিবারের যাবতীয় কাজে স্ত্রীদের সহযোগীতা করতেন। এমনকি তিনি আয়েশা (রাঃ) কে রুটি বানানোর কাজেও সাহায্য করতেন।

আসওয়াদ ইবনে ইয়াযিদ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- “আমি আয়েশা (রাঃ) প্রশ্ন করলাম, হুযুর (সাঃ) বাড়ীতে কি করতেন? তিনি বললেন, পরিবারের যাবতীয় কাজ করতেন। আযান শুনলে বাইরে চলে যেতেন।”

স্ত্রীদেরকে অবশ্যই শরীয়তসম্মত পর্দার ভেতর থাকতে হবে। স্ত্রী যত বেশী বেগানা পুরুষের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করবে এবং গল্প-গুজব করবে- ততই সে দিন দিন স্বামীর অবাধ্য হয়ে যাবে, তাই সাংসারিক শান্তি রক্ষার্থে স্ত্রীর জন্য পর্দা রক্ষা করা আবশ্যক।

এ প্রসঙ্গে সূরা নূরের ৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “হে নবী! মুমিন স্ত্রী লোকদের বলে দিন, তারা যেন নিজেদের চোখকে বাঁচিয়ে রাখে। এবং নিজেদের লজ্জাস্থান সমূহের হেফাজত করে ও নিজেদের সাজসজ্জা না দেখায়। কেবল সেই সব স্থান ছাড়া যা আপনা থেকেই প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এবং নিজেদের বুকের উপর ওড়নার আঁচল ফেলে রাখে। আর নিজেদের সাজসজ্জা প্রকাশ করবে না।”

ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন- "মহিলারা হল পর্দায় থাকার বস্তু। সুতরাং তারা যখন (পর্দা উপেক্ষা করে) বাইরে আসে, তখন শয়তান তাদেরকে (অন্য পুরুষের চোখে) সুসজ্জিত করে দেখায়।" (তিরমিযী)

দৃষ্টির অসাধারণ শক্তি আছে বলেই আল্লাহ পাক পুরুষ ও নারীকে দৃষ্টি নিয়ন্ত্রন করার জন্য আদেশ করে বলেছেন যে- “মুসলিম নর-নারী যেন স্বীয় চোখের দৃষ্টি নীচের দিকে রাখে।”

নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “আল্লাহর অভিশাপ ঐ সকল নারীদের উপর যারা কাপড় পড়লেও উলঙ্গ মনে হয়।”
হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, “নারীদের এমন আঁটসাঁট কাপড় পড়তে দিওনা যাতে শরীরের গঠন পরিস্ফুটিত হয়ে পড়ে।”

শিক্ষিত অশিক্ষিত, ধনী-গরীব, সুন্দর-কুৎসিৎ সকল স্ত্রীদেরকেই তার স্বামীর পূর্ণ আনুগত্য স্বীকার করে নিতে হয়। মনে প্রাণে স্ত্রীকে উপলব্ধি করে নিতে হবে যে-
* স্বামীর গার্হস্থ্য বিষয়াদি স্ত্রীর গার্হস্থ্য বিষয়।
* স্বামীর সন্তান স্ত্রীর সন্তান।
* স্বামীর মান-ইজ্জত স্ত্রীর মান ইজ্জত।
* স্বামীর সন্তান-সন্তুতি লালন-পালন করা স্ত্রীর দায়িত্ব।
* স্বামীর শরীর ও স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখাও স্ত্রীর দায়ীত্ব।
* স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েই যদি উভয়ের দায়ীত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকেন, তবে সংসার হবে সুশৃঙ্খল এবং আসবে শান্তি।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন-“আমার আদর্শ বৈবাহিক জীবন যাপন করা। যে আমার আদর্শকে তুচ্ছজ্ঞান বা ঘৃনা করবে তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।”
আসুন আমরা স্বামী-স্ত্রী সকলে নবীর আদর্শে উজ্জিবীত হয়ে পথ চলি, নবীর সুরে কথা বলি। লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ হতে বেঁচে থাকি।

‘অভাব এলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়।’ আমাদের জীবনে যেন এমনটি না ঘটে।
পার্থিব ও বৈষয়িক বিষয়ে সব সময় আমাদের চেয়ে নিম্ন অবস্থা সম্পন্নদের প্রতি দৃষ্টি রাখবো এবং দ্বীনের কাজে যারা আমাদের উর্ধ্বে সর্বদা তাদের অনুসরণ করবো। তাহলে আমরা দুনিয়ায়ও সুখী হবো। পরকালের জন্যও নেক-আমল করার তৈফিক পাবো।

‘কোথায় স্বগর্, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদুর,
মানুষের মাঝেই স্বর্গ-নরক, মানুষেতেই সুরাসুর।’
প্রীতি ও প্রেমের পূণ্য বাঁধনে সবে মিলিব পরস্পরে,
বেহেশত আসিয়া দাঁড়াবে তখন আমাদেরই কুড়ে ঘরে।'



প্রকাশ ঃ দৈনিক ইনকিলাব, (ইসলামী জীবন)
২০, ২২, ২৭ জুলাই, ২০০৮।               
          
৪. কোরবানীর গুরুত্ব ও জরুরী মাসায়িল
লেখক ঃ খন্দকার নাজনীন সুলতানা


ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান হলো ‘কোরবানী’। নামায, রোযার ন্যায় কোরবানীও পূর্ববর্তী নবীদের জন্য অবশ্য করনীয় ছিল। উম্মতে মুহাম্মদীর উপরও কোরবানী ওয়াজিব। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, ‘ঈদুল আজহার দিনে আল্লাহর কাছে কোরবানীই সর্বাপেক্ষা প্রিয় ও বড় ইবাদত।’

পবিত্র আল কুরআনের সূরা হজ্জ-এর ৩৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন- "আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানী নির্ধারন করেছি। যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারন করে। অতএব তোমাদের আল্লাহতো একমাত্র আল্লাহ। সুতরাং তাঁরাই আজ্ঞাধীন থাক এবং বিনয়ীগনকে সুসংবাদ দাও।"

কোরবানীর পশু জবেহ করার সময় প্রথম রক্তের যে ফোঁটা পড়ে তা মাটিতে পড়ার পূর্বেই আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীসে আছে- "রাসুল করীম (সাঃ) বলেছেন, “কোরবানীর দিনে মানব সন্তানের কোন নেক কাজই আল্লাহর নিকট তত প্রিয় নয় যত প্রিয় কোরবানীর পশুর রক্ত প্রবাহিত করা। কোরবানীকৃত পশুগুলো তাদের শিং, পশম ও ক্ষুরসহ কিয়ামতের দিন কোরবানী দাতার পাল্লায় এনে দেয়া হবে। কোরবানীর পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর নিকট সম্মানিত স্থানে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা আনন্দ চিত্তে কোরবানী করবে।" (তিরমিযী, ইবনে মাযাহ)

প্রাপ্তবয়স্ক, সামর্থবান প্রতিটি মুসলমানের জন্য কোরবানী করা ওয়াজিব। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন-“সামর্থ থাকা সত্বেও যে কোরবানী  করবে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে।" (মুসনাদে আহমদ/ ইবনে মাজা)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, “প্রিয় নবী (সাঃ) মদীনায় দশ বছর অবস্থান করেছেন, এ সময় তিনি প্রতি বছর কোরবানী করতেন।” (তিরমিযি)

মুসলমানদেরকে সহীহ নিয়তে কোরবানী করতে হবে। আল্লাহর ইচ্ছা-কোরবানীদাতার ঐকান্তিক নিষ্ঠা,
আন্তরিকতা ও আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যেই যেন কোরবানী  দেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর ঘোষনা হচ্ছে, “বল আমার নামায, আমার কোরবানী, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহরই জন্য।”

অন্যত্র আল্লাহ ঘোষনা করেন- “কোরবানীর পশুর গোশত ও রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছে না, পৌঁছে তার নিকট শুধুমাত্র তোমাদের তাকওয়া-পরহেজগারী।”

অর্থাৎ কোরবানী  হওয়া উচিৎ শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তষ্টির মানসে। পবিত্র আল কুরআনের সূরা হজ্জ এর ৩৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “কোরবানীকৃত পশুর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন। যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষনা কর। এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎ কর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দাও।”

যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখ সন্ধার মধ্যে এ তিন দিন কোরবানী করার সময়। এ তিন দিনের যে দিন ইচ্ছে সে দিনই কোরবানী করা যায়। তবে প্রথম দিন কোরবানী করা উত্তম। তারপর দ্বিতীয় দিন, তারপর তৃতীয় দিন। ঈদের নামাযের পরেই কোরবানী দেবার নিয়ম। কোরবানীর পশু নিজেদের হাতে যবেহ করা মুস্তাহাব। নিজে যবেহ করতে না পারলে অন্য নেককার ও আলেম দিয়ে যবেহ করা উত্তম। এ সময় নিজে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো। স্ত্রীলোক পর্দার রক্ষার্থে সামনে না থাকলে কোন ক্ষতি নেই। (বেহেশতী জেওর- ৩য় খন্ড)

ছয় প্রকার গৃহপালিত পশু নর-মাদী উভয়ই কোরবানী  করা যায়। যেমনঃ উট, গরু, মহিষ, দুম্বা, ভেড়া ও ছাগল। নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাব ছাড়া যার নিকট নিসাব পরিমান সম্পদ আছে অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য কিংবা তৎসম মূল্যের জিনিসপত্র অথবা নগদ টাকা বা ব্যবসার মাল। তার উপর কোরবানী করা ওয়াজিব। কোরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য সেই মাল বছরকাল স্থায়ী থাকা শর্ত নয়। নেসাব পরিমান সম্পদশালী ব্যক্তি আকিল-বালিগ ও মুকীম হওয়া আবশ্যক।

ভেড়া, দুম্বা ও ছাগল একজনের পক্ষ থেকে একটাই কোরবানী করতে হবে। আর গরু, মহিষ ও উট অনুর্দ্ধ সাতজন শরীক মিলে কোরবানী  করতে পারবে। শরীকে কোরবানীর ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় বিশেষ ভাবে লক্ষনীয়।
(১) কোরবানী  বা আকীকার সুস্পষ্ট নিয়ত করা।
(২) শরীকদারদের ভাগের টাকায় কম-বেশী না হওয়া।
(৩) কোরবানী পশুর গোশত সমানভাবে বন্টন করা।

কোরবানীর পশুর উপর আরোহন করা বা তাকে দিয়ে কোন কাজ করানো যেমন, হাল চাষ করা, পানি উঠানো, গাড়ী টানানো ইত্যাদি মাকরুহ। কেউ এরূপ করে ফেললে সেই পরিমান মজুরী সদকা হিসাবে দরিদ্রদের দিয়ে দিতে হবে। কোরবানীর পশুর দুধ দোহন করাও জায়িয নয়, যদি কেউ ভুল করে বা পশুর কষ্ট লাঘবের জন্য দুধ দোহন করে, তবে তাও সদকা হিসাবে দিয়ে দিতে হবে।

কোরবানীর গোশত তিন ভাগ করা মুস্তাহাব। নিজ ও নিজ পরিবার পরিজনের জন্য এক ভাগ, আত্মীয়-স্বজনের জন্য এক ভাগ ও ফকীর-মিসকীনদের জন্য এক ভাগ। পরিবারের লোক সংখ্যা বেশী হলে, নিজেদের জন্য পরিমানে বেশী রাখা যাবে। কিন্তু মান্নতের কোরবানীর ক্ষেত্রে সব গোশতই সদকা করা ওয়াজিব।

কোরবানীকৃত পশুর চামড়া বিক্রি না করে দান করা যাবে। আর বিক্রি করলে তার মূল্য সদকা করা ওয়াজিব।

হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর অতি আদরের পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে কোরবানী করেন। কিন্তু আল্লাহর অশেষ মহিমায় পুত্রের পরিবর্তে দুম্বার কোরবানী হয়। মিনার নির্জন প্রান্তরে দুই নবী কোরবানীর মাধ্যমে যে বিশাল ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, তা চির দিনের জন্য আল্লাহর দরবারে মকবুল হয়ে রইল। সকল বান্দাকে সে আদর্শে উজ্জিবিত হওয়ার মানসেই প্রতি বছর কোরবানীর নিয়ম।

হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও হযরত ইসমাঈল (আঃ) অমরত্বের পুরস্কারে পুরস্কৃত হলেন। শত শত বছর ধরে মানুষ সে ত্যাগকে  স্মরণ করছে। যুগে যুগে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে আল্লাহর জন্য নিজের সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তুর কোরবানী করা ও আত্মদানে।

মানুষের ভেতরকার পশুত্ব, সব খারাপ ও নোংরামীকে কোরবানী করাই কোরবানীর মূল উদ্দেশ্য। শুধুমাত্র প্রতীকী কোরবানী নয় আল্লাহর তরে সত্যিকারভাবে কোরবানী করে আমরা যেন হয়ে উঠি নিস্পাপ ও আদর্শবান্দা রুপে। আমীন। 

প্রকাশঃ পাক্ষিক ইতিকথা, ৫ডিসেম্বর, ২০০৮।

৫. নারীর স্বার্থ সংরক্ষণে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)

/ ইসলামে নারীর অধিকার
লেখক ঃ খন্দকার নাজনীন সুলতানা

ইসলাম পূর্ব জাহেলী যুগে নারীদেরকে সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীবের ন্যায় মূল্যায়ন করা হতো। নারী যেন গৃহস্থালী আসবাবপত্র। অন্যান্য পন্যদ্রব্যের মতো নারীদেরও ক্রয় বিক্রয় করা হতো। বিয়ে-সাদীতে নারীর কোন মতামত গ্রহণ করা হতো না। আতœীয়-স্বজনের সম্পত্তিতে নারীদের কোন অধিকার ছিল না। ক্ষেত্র বিশেষে নারীরা স্বয়ংই মীরাসের মালের ন্যায় বন্টিত হতো। ধর্ম-কর্ম বা ইবাদত উপাসনায়ও নারীদের ডাকা হতো না। ভাবা হতো নারীদের বেহেশতে যাবার কোন যোগ্যতাই নাই। অন্ধকার যুগে নারীদের প্রতি পুরুষরা এতই নির্মম, নিষ্ঠুর ও নির্দয় ছিল যে, মেয়েদেরকে জ্যান্ত কবরও দেয়া হতো।
শুধু আরবেই নয় বিশ্বের অনেক স্থানেই নারীরা ছিল চরম লাঞ্চিত ও উপেক্ষিত।

রোমের এক সংসদে পারস্পরিক পরামর্শক্রমে সাব্যস্ত করা হয়েছিল যে, নারী হলো এক অপবিত্র জানোয়ার যার আত্মাও মূল্যহীন। কোন কোন জাতির মাঝে স্বামীর মৃত্যু হলে স্বামীর সাথে স্ত্রীকেও চিতায় পুড়ে মরতে হতো। ৫৮৬ খ্রীষ্টাব্দে ফরাসীরা এক পর্যায়ে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, শুধুমাত্র পুরুষের সেবার জন্যই নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে। খ্রীষ্টানরা নারীদেরকে মনে করতো এরা পাপী ধংসাত্মক প্রেম দায়িনী। এদের ছায়াও অভিশপ্ত। অর্থাৎ মহানবী (সাঃ) এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে সারা বিশ্বের সকল ধর্মই নারীদের উপেক্ষা করতো। নারীর প্রতি পুরুষের আচরণ ছিল অত্যন্ত হৃদয় বিদারক ও অমানবিক। নারীরা ছিল বড়ই অসহায়।

আল্লাহর অশেষ রহমতের আধার মানবতার নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নারীদের এরূপ অসহায়ত্ব দেখে অত্যন্ত দুঃখ পান। তিনিই সর্বপ্রথম নারীদের সকল অসহায়ত্ব দূর করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠা করেন হিলফুল ফুজুল। তিনি ঘোষণা করেন, গোটা দুনিয়ার মাঝে শ্রেষ্ঠ সম্পদ হচ্ছে ধার্মিকা নারী। নবী কারীম (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি দুইটি মাত্র মেয়ের সুন্দররূপে ভরণ-পোষন ও প্রতিপালন করবে, সে বেহেশতে আমার এত নিকটবর্তী হবে যেরূপ হাতের আঙ্গুলসমূহ পরস্পর নিকটবর্তী।”  (মুসলিম শরীফ)
মেয়েরা কখনই ফেলনা নয়। মেয়েদেরকে যেন তাদের অভিভাবকরা সুন্দর ভাবে লালন পালন করেন সে মর্মে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি তিনটি মেয়ে বা তিন জন ভগ্নীর প্রতিপালন ও শিক্ষাদান সূচারু রূপে করবে যতদিন না তাদের নিজ নিজ ব্যবস্থা হয়, তার জন্য বেহেশত অবধারিত হয়ে যাবে। দুই জন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে নবী কারীম (সাঃ) বললেন, দুই জনের প্রতিপালনেও তাই। একজনের প্রতিপালন সম্পর্কেও নবীজী তাই বললেন।”  (মেশকাত শরীফ)
মেয়েদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা উচিৎ নয়। সন্তান প্রতিপালনে যেন ছেলে-মেয়েতে ভেদাভেদ না করা হয় সে সম্পর্কে নবী কারীম (সাঃ) বলেছেন, "যার কাছে কোন মেয়ে থাকে এবং সে যদি মেয়েকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করে এবং ছেলেকে অগ্রগণ্য না করে, আল্লাহ তাকে বেহেশত দান করবেন।"  (আবু দাউদ)

কোন কারনে যদি মেয়ে স্বামী পরিত্যাক্ত হয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে আসে তবে বাবা-মা ও ভাইদের উচিৎ তার জন্য ব্যয় করা। এর জন্য তারা যেন তাকে খোটা না দেয়, কারণ এ ব্যয় উত্তম সদকা হিসাবে গন্য হবে। এ প্রসঙ্গে নবী (সাঃ) বলেছেন যে, “তোমার কোন মেয়ে স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে নিরাশ্রয় রূপে তোমার আশ্রয়ে ফিরে আসলে, তার জন্য তুমি যা ব্যয় করবে তা তোমার জন্য সর্বাধিক উত্তম দান-খয়রাত হিসাবে গন্য হবে।”  (ইবনে মাজা শরীফ)

এ পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাবে আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের পরীক্ষা করেন। কন্যা সন্তান দিয়ে এবং কন্যা
সন্তানের উপর নানা প্রকার বিপদ আপদ দিয়েও আল্লাহর তরফ হতে অভিভাবকদের পরীক্ষা করা হয়। এ পরীক্ষায় যে জয়ী হবে সে ইনশাল্লাহ জাান্নাতবাসী হবে।

এ প্রসঙ্গে একটি হাদীস উল্লেখ করা যায়। হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “একদা একজন বিপন্না মহিলা তার দুটি কন্যা সন্তান সহ আমার কাছে কিছু পাওয়ার আশায় এসেছিল কিন্তু আমার কাছে তখন একটি খুরমা ব্যতিত অন্য কোন খাদ্য ছিল না। আমি তাকে তাই দিলাম। মহিলা খুরমাটি দু’ভাগ করে দুই কন্যাকে দিল এবং নিজে কিছু খেল না। অতঃপর সে চলে যাওয়ার পর পরই নবী করীম (সাঃ) ঘরে প্রবেশ করলেন এবং আমি তাঁকে ঘটনাটির আদ্যপান্ত বললাম। হুযুর (সাঃ) বললেন, যাকে আল্লাহ এ ধরনের কন্যা সন্তান দিয়ে পরীক্ষায় ফেলেছে, অতঃপর সে কন্যাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করে। (কিয়ামতে) এ কন্যাই তার জন্য দোযখের ঢাল স্বরূপ হবে।”   (বুখারী, মুসলিম)

কন্যা সন্তানরা আল্লাহর রহমত স্বরূপ এ পৃথিবীতে আসে। তাই কখনই কন্যাদের অবজ্ঞা ও অবহেলা করা উচিৎ নয়। কন্যার উছিলাতেই অভিভাবকরা ইহকালে ও পরকালে উভয় জগতেই আল্লাহর নৈকট্য ও সাহায্যপ্রাপ্ত হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে আর একটি হাদীসে পাই, নাবীত ইবনে শুরাইত (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, "আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, যখন কোন ব্যক্তির কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে, সেখানে আল্লাহ ফেরেশতাদের পাঠান। তারা গিয়ে বলে, তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক হে ঘরবাসী। তারা কন্যাটিকে তাদের ডানার ছায়ায় আবৃত করে নেয়, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় এবং বলে একটি অবলা জীবন থেকে আরেকটি অবলা জীবন ভূমিষ্ট হয়েছে এর তত্ত্বাবধানকারী কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্ত হবে।"

রিযিকের মালিক আল্লাহ। তাই কখনই অভাবে ও দুঃখ-কষ্টে কন্যাদের মৃত্যু কামনা করা উচিৎ নয়। আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, "তাঁর কাছে এক ব্যক্তি বসা ছিল। তার ছিল বেশ কটি কন্যা সন্তান। সে কন্যাদের মৃত্যু কামনা করছিল। শুনে ইবনে উমর অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বললেন, তাদের রিযিকদাতা কি তুমি?"  (আদাবুল মুফরাদ)

নারীরা আল্লাহর কাছেও অত্যন্ত প্রিয়। তাইতো নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “তোমাদের সন্তানদের মধ্যে মেয়েরাই উত্তম।”
মাতৃত্বের অপরিসীম মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী (সাঃ) বিশ্ববাসীকে জানালেন, “মায়ের পায়ের নীচে
সন্তানের বেহেশত।” অর্থাৎ যে নারীকে জাহান্নাম সৃষ্টির কারণ মনে করা হতো সেই নারীর পায়ের নীচেই ঠাঁই হলো বিশ্ববাসীর জান্নাত। নারীর জন্য এর চেয়ে বড় সম্মান ও নেয়ামত আর কি হতে পারে?

দোষ-গুন মিলিয়েই মানুষ। নারী-পুরুষ উভয়ের মাঝেই কিছুনা কিছু দোষ থাকতে পারে। তাই বলে তাকে ঘৃনা বা অবহেলা করা উচিৎ নয়। তাকে শুধরে দেয়া সকলের কর্তব্য। সকলের মাঝের গুণগুলোকে অন্বেষণ করেই সকলকে ভালবাসতে হবে। তবেই সকলের মাঝে সম্প্রতি গড়ে উঠবে। এ সম্পর্কে নবী করীম (সাঃ) বলেন, “কোন ঈমানদার পুরুষ যেন কোন ঈমানদার নারীকে ঘৃণা না করে, কেননা তার (নারীর) মাঝে একটি ব্যাপার যদি অপছন্দনীয় থাকে, তা হলে তার অপরাপর গুনাবলী নিশ্চয়ই পছন্দনীয় পাওয়া যাবে।”

যে সব স্বামীরা স্ত্রীদের গায়ে হাত তোলে, মারধর করে এরা মোটেও ভালো স্বামী নয়। নবী (সাঃ) বলেছেন, “সহধমিনীর সাথে যে উত্তম জীবন যাপনকারী হয়, সেই উত্তম মানুষ। আমি আমার সহধর্মিনীদের সাথে উত্তম জীবন যাপন করি।" (তিরমিযী শরীফ)

একদা নবীকারীম (সাঃ) কড়া নির্দেশ দিলেন, ”গৃহিনীদেরকে কেহ প্রহার করতে পারবে না। অতপর একদিন ওমর (রাঃ) নবীজীর কাছে প্রকাশ করলেন, নারীরা অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে গিয়েছে। সেমতে নবী করীম (সাঃ) (প্রয়োজন হলে সংযমের সাথে) প্রহারের অনুমতি দিলেন। এরপর বহু সংখ্যক মহিলা তাদের স্বামীদের অভিযোগ নিয়ে নবীজীর গৃহে ভিড় জমালো। তখন রসূলুল্লাহ (সাঃ) কঠোর ভাষায় বললেন, অনেক মহিলা তাদের স্বামীদের সম্পর্কে অভিযোগ করছে, এরূপ স্বামীগন মোটেই ভালো মানুষ নয়।”  (আবু দাউদ শরীফ)

নবী কারীম (সাঃ) বলেছেন, "নারীরা নামাজ, রোজা, সতীত্ব রক্ষা ও স্বামীর আনুগত্য এই সংক্ষিপ্ত আমল দ্বারা আল্লাহ তা’য়ালার কাছে এত বড় মর্যাদা লাভ করবে যে বেহেশতের যে কোন শ্রেণীতে সে প্রবেশ করার অধিকার লাভ করবে।"  (মেশকাত, ২৮১)

মুহাম্মদ (সাঃ) আরো বলেছেন, "পরিপূর্ণ ঈমানদার ঐ ব্যক্তি যে তার সহধর্মিনীর সাথে সদ্ব্যবহার করে এবং তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়।"  (তিরমিযী শরীফ)

আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) তার সহধর্মিনীদের প্রতি অতি উত্তম ছিলেন। "একবার সফর অবস্থায় বিবি সফিয়া (রাঃ) উটের উপর উঠতে পারছিলেন না বলে নবী করীম (সাঃ) নিজ উরু পেতে দিলেন। সফিয়া (রাঃ) সিঁড়ির ন্যায় নবীজীর উরু মোবারকের উপর পা রেখে উটে আরোহন করলেন।"  (বোখারী শরীফ)

 সহধর্মিনীদের সাথে নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সর্ম্পক অত্যন্ত সুমধুর ছিল। আয়েশা (রাঃ)-এর মাত্র ৬ বছর বয়সে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে বিয়ে হয়। ৯ বছর বয়সে তাঁকে নবীজির ঘরে  তুলে নেয়া হয়। তখন নবী কারীম (সাঃ)-এর বয়স ছিল ৫০ বছর। নবী (সাঃ) আয়েশা (রাঃ)-এর বাল্য বয়সের প্রতি সর্বদাই লক্ষ্য রাখতেন। আয়েশা (রাঃ) যেন কখনও মনে দুঃখ-কষ্ট না পান সে বিষয়গুলো সবসময়ই মনে রাখতেন। আয়েশা (রাঃ) এর সাথে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) দৌড় প্রতিযোগীতায়ও অংশ গ্রহন করেছিলেন।

স্ত্রীদের প্রতি মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন অনেক মর্যাদাবান ও সহানুভূতিশীল। ঐতিহাসিক ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিদায় হজ্জ্বের ভাষনে নবী (সাঃ) বলেছেন, “নারীদের উপর স্বামীদের যেরুপ হক ও দাবী আছে তদ্রুপ স্বামীদের উপর স্ত্রীদেরও হক ও দাবী আছে।”

তিনি আরো বলেছেন, “নারীদের প্রতি আমার বিশেষ নির্দেশ পালন করো তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার ও সর্বাধিক কল্যাণকর  সম্পর্ক বজায় রেখো।”

স্ত্রীর অধিকার সম্পর্কে নবী করীম (সাঃ) বলেছেন যে, “নারী জাতি সৃষ্টিগত ভাবেই একটু বক্র স্বভাবের পূর্ণ সোজা করতে চাইলে (সোজা না হয়ে) ভেঙ্গে যাবে। তথা বিচ্ছেদের পাল্লায় এসে যাবে। সুতরাং তাকে বাঁকা থাকতে দিয়েই তার সাথে তোমার জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। তোমাদের প্রতি আমার বিশেষ উপদেশ, তোমরা নারীদের প্রতি উত্তম ও ভালো হয়ে থাকবে।”  (মুসলিম শরীফ)

নবী করীম (সাঃ) শুধুমাত্র নারীদের মর্যাদাই দেননি, সাথে সাথে অধিকারও সংরক্ষন করেছেন। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, মানবিক, ধর্মীয়, শিক্ষাগত, নিজস্ব সম্পদ স্বাধীন ভাবে ব্যায়, পৈত্রিক, স্বামীর ও আত্মীয়দের পরিত্যাক্ত সম্পদে অধিকার লাভসহ মানব জীবনের আর যতো অধিকার থাকতে পারে, সবই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নারীদের দিয়েছেন।

পবিত্র কোরআনের সূরা নিসার ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “হে ঈমানদারগন! বলপূর্বক নারীদেরকে উত্তরাধিকার গ্রহণ করা তোমাদের জন্য হালাল নয় এবং তাদেরকে আটকে রেখো না।”
হাকিম ইবনে মুয়াবিয়া (রাঃ) তার পিতা মুয়াবিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করেছিলাম হে আল্লাহর রাসূল, স্বামীর উপর স্ত্রীর কি কি অধিকার রয়েছে? মহানবী (সাঃ) বললেন-
১) তোমরা যা খাবে, তাই তাদের খাওয়াবে।
২) তোমরা যা পরবে, তাই তাদের পরাবে।
৩) তাদের মুখমন্ডলের উপর মারবে না।
৪) তাদেরকে খারাপ ও অশ্লীল গালাগালি করবে না। এবং
৫) ঘর ছাড়া অন্য কোথাও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করবে না।

নারীর সমস্ত অধিকার ও প্রাপ্তিগুলো নারীদেরকে দেয়া না হলেই পুরুষরা গুনাহগার হিসাবে গন্য হবে। হাদীসে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে,
“একজন লোকের গুনাহগার হবার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, যাদের (অর্থাৎ স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ইত্যাদি) ভরণ পোষণের দায়িত্ব তার উপর অর্পিত, তাদের প্রতি সে সকল ব্যাপারে সে চরম উপেক্ষা দেখাবে।”

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, "পূর্ণ মুমিন সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র উত্তম এবং যে তার পরিবার-পরিজনের (স্ত্রী-পুত্রদের) প্রতি সদয়।"  (তিরমিযী)

মুসলিম সমাজে ইসলাম কোরআন ও হাদীসের মাধ্যমে নারীর যে অধিকার ও পদমর্যাদা দিয়েছে তার সবটুকু কৃতিত্বের দাবীদার হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা। ইসলাম পূর্বে অন্যান্য ধর্মে নারীদের প্রতি যে নির্যাতন, ঘৃণা, তুচ্ছ-তাচ্ছিলতা, উপেক্ষা ও অন্যায়-অত্যাচার করা হতো, মহানবী (সাঃ) এর বিরোধীতা করে নারীকে দিয়েছেন অপরিসীম সম্মান ও অপরিমেয় অধিকার।

জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রেও ইসলাম নারী-পুরুষের মাঝে কোন ভেদাভেদ সৃষ্টি করেননি। মহানবী (সাঃ) এ প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর বিদ্যার্জন ফরজ।’

ইসলাম ঘৃনতম অবস্থা হতে নারীজাতিকে কল্যানময়ী ও পূর্ণময়ী রুপ দিয়ে গৌরবের উচ্চাসনে বসিয়েছেন। নারীর জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন সর্বময় অধিকার। পবিত্র আল-কোরআনের সূরা নিসার ৭নং আয়াতে ঘোষিত হয়েছে, “নারীদের রয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নির্ধারিত অংশ।” স্বামীদেরকে বলা হয়েছে স্বামীরা যেন সন্তুষ্ট চিত্তে স্ত্রীদের প্রাপ্য মোহরানা শোধ করে দেয়। এছাড়াও জমি-জমার মালিকানা, বিবাহে সম্মতি, ন্যায্য অধিকার না পাবার কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ, ধন-সম্পদ অর্জন ও তা স্বাধীন ভাবে খরচ করা, ইচ্ছানুযায়ী দান-সদকা করা, নামায-রোজা, হজ্জ্ব-যাকাত ও অন্যান্য এবাদত সমূহে এবং ধর্মীয় বিধি-নিষেধ তাকে পুরুষের সম অধিকার এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নারীকে অগ্রাধিকার প্রদান করেছে ইসলাম।

 সম্প্রতি কিছু সংখক নারী সমঅধিকারের জন্য লড়াই করে ‘নারী পুরুষ সমঅধিকার’ আইনও পাস করিয়ে নিয়েছেন। কি বুদ্ধি তাদের! ইসলাম নারীকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দিয়েছে অগ্রাধিকার আর ওনারা সমঅধিকারের জন্য লড়াই করেছেন। সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। তা না হলে কি আর কেউ অধিকার কমায়? ইসলামে যেহেতু একজন নারীর তুলনায় একজন পুরুষের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অধিকার কম রয়েছে, তাই একজন পুরুষ দাবী তুলতে পারে যে, আমরা সম অধিকার চাই। নিতান্তই গবেট না হলে একজন নারী কি করে অগ্রাধিকার বাদ দিয়ে সমঅধিকারের জন্য লড়তে পারে? আসলে ওসব গুটিকয়েক সমঅধিকারের জন্য লড়াইকৃত নারীদের দোষ দিয়ে লাভ কি? ওনাদের মস্তিষ্ক উন্নতমানের বিদেশী ঔষধ দিয়ে ধোলাই করে দেয়া হয়েছে। ইসলামে নারীর কি কি অধিকার রয়েছে তা না জেনেই ওনারা ‘কান নিয়ে গেছে চিলে’ বলে চিলের পিছে ছুটোছুটি করছেন। আরে কানতো কানের জায়গাতে আছে। তবে তা দেখার মত সুস্থ চোখ ও অনুভূতি প্রয়োজন।

আগে বাসে নারীরা দাঁড়িয়ে থাকলে পুরুষরা উঠে নারীদের বসতে জায়গা দিত। ভাবতো আহা ‘মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেস্ত’ সেই মায়ের জাতি দাঁড়িয়ে আছে তাই কি হয়? আপা, মা, বোন কিংবা খালা বসুন বসুন। কত সম্মান করা হতো মেয়ে জাতিদের। আর এখন মায়ের বয়সী কেউ দাঁড়িয়ে থাকলেও অনেক পুরুষরা উঠে বসার জায়গা দিতে চান না। বলেন, এখন সমঅধিকারের যুগ। আমরা পুরুষরা দাঁড়িয়ে থাকলে নারীদের দাঁড়াতে অসুবিধা কোথায় ? পুরুষদের দোষ দিচ্ছি না। সমঅধিকারের লড়াইয়ে জেতার পর এসব হলো পুরুষদের পক্ষ থেকে নারীদের প্রাপ্ত উপযুক্ত অভিনন্দন।

আগে বাসে ওঠার সময় পুরুষরা নারীদের জায়গা দিয়ে বলতো, ঠিক আছে আপনারা বাসে আগে উঠুন। এখন আর বলে না। আর বলবেই বা কেন? সমঅধিকার বলে কথা। এখন যুগ সমঅধিকারের। চাকুরীজীবি স্বামী, স্ত্রীকে বলে আমি কষ্ট করে চাকরী করে টাকা উপার্জন করছি। আর তুমি ঘরে বসে কি করো? তুমিও চাকরী করো। যে স্বামী ইট ভাঙ্গে সেও তার স্ত্রীকে দিয়ে ইট ভাঙ্গাচ্ছে।যে স্বামী মাটি কাটে সেও তার স্ত্রীকে দিয়ে মাটি কাটাচ্ছে।

 আগে বাইরের পরিশ্রমের কাজগুলো পুরুষরা  করতো। আর সন্তান জন্মদান, প্রতিপালন, খাওয়ানো, সেবা-যতœ, রান্না এসব ঘরের কাজগুলো নারীরা করতো। আর এখন রাস্তা তৈরী, ইট ভাঙ্গানো, দালানের গাঁথুনী দেয়া, মাটি কাটা, মাটি বহন করা এসব বাইরের পরিশ্রমের কাজগুলোও অনেক ক্ষেত্রে নারীকে দিয়ে করানো হচ্ছে। ঘরে ঘরে সৃষ্টি হচ্ছে অশান্তি । সমঅধিকারের ফলাফল।

বেকার পুরুষরা বিয়ে করতে পারছে না। ফলে অনেক নারী অবিবাহিত থেকে যাচ্ছে। বেহায়াপনা, নিলর্জ্জতা, অবাধ যৌনাচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। স্ত্রী চাকরী করছে, স্বামী বেকার। তখন বেকার স্বামী মানসিক অস্থিরতায় ভুগছে। চাকুরীজীবি নারী বেকার স্বামীর অবাধ্য হয়ে উঠছে। ঘরে ঘরে ঝগড়া, মারা-মারি, বিশৃংঙ্খলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভাঙ্গছে রহমতে পরিপূর্ণ স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন।

‘সমঅধিকার’ তাই মেয়েরা স্যালোয়ার-কামিজ ওড়না ছেড়ে সার্ট-প্যান্ট পড়ছে। যুক্তি হলো ‘ছেলেরা পড়তে পারলে আমরা পারবোনা কেন? লংঘিত হচ্ছে নারীর পর্দা।

নারী জাতির প্রতি আমার আবেদন-আসুন, মা-বোন কিংবা কন্যারা, সমঅধিকারের জন্য লড়াই নয়। ইসলাম নারীদের যে অধিকার গুলো দিয়েছে তা সম্পর্কে সচেতন হই। প্রয়োজনে সে অধিকার গুলোর যথাযথ বাস্তবায়নের চেষ্টা করি। যৌতুক প্রথা বন্ধ করি। ইসলামী উত্তরাধিকার আইনে নারীর প্রাপ্ত সম্পত্তি বুঝে নেই। স্ত্রীদের উপর অমানুষ স্বামীদের অত্যাচার বন্ধ করাই। ভাইয়ের উপর বোনের অধিকার, পিতার উপর কন্যার অধিকার আদায় করি। ‘লজ্জ্বাই নারীর ভূষন’ আর ইসলামী পর্দায় থেকে কাজ করার অধিকার নারীর মৌলিক অধিকার। এ অধিকার গুলো বাস্তবায়নে সোচ্চার হই।

 আমরা আর নটের মতো চলবো না। তোতার মতো শেখানো বুলি আওড়াবো না। নিজেরাই কোরআন-হাদীস অধ্যয়ন করে জেনে ও বুঝে নেই-আমাদের কি কি অধিকার, দায়ীত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। নারী হিসাবে পরিবার দেশ-জাতি ও সমাজের কাছে আমাদের করনীয় কি? চাওয়া-পাওয়া কি? আমরা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কতটুকু পালন করছি। আর আমরাই যদি দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা করি, তবে তা সংশোধনের জন্য আমাদের কি করা উচিৎ। তারপর অধিকার নিয়ে লড়াই করি। অন্যের দোষ-ত্র“টি ও গন্ধ তালাশ করার আগে নিজের দোষ-ত্র“টি গুলো সংশোধন করে নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয় কি? আসুন বুদ্ধিমতি হই, ঠিক কাজটি করি। আমাদের শ্লোগান হোক,

“সমঅধিকার নয়, আমরা চাই ইসলামে নারীকে প্রদত্ত অগ্রাধিকার সমূহের সঠিক বাস্তবায়ন।”

প্রকাশঃ দৈনিক ইনকিলাব, ১০ মার্চ ২০০৯।

৬. ঈদুল ফিতর ঃ সানন্দ ইবাদত/
রোজায় আল্লাহর উপহার ঃ ঈদুল ফিতর

বইয়ের নামঃ ফী ত্বলাবুল জান্নাত (জান্নাতের খোঁজে)
লেখক ঃ খন্দকার নাজনীন সুলতানা


রমজান মাসের দীর্ঘ এক মাস রোজা পাালনের পর শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে মুসলিম জাহানে যে আনন্দোৎব উদযাপিত হয় তাই ঈদুল ফেতর। ঈদ অর্থ খুশী বা আনন্দ আর ফিতর অর্থ উপবাস ভঙ্গকরন। অর্থাৎ ঈদুল ফেতর হল উপবাস ব্রত ভঙ্গের উৎসব।

ঈদের দিন ও ঈদের রাত্রিতে ইবাদতের ফজিলত অসীম। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যে পাঁচটি রাতে দোয়া কবুল হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন, তার মাঝে ঈদুল ফেতরের রাত অন্যতম।

হযরত রাসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন," ঈদুল ফেতরের দিন উপˉি’ত হলে আল্লাহতায়ালা রোজাদারদের বিষয়ে ফেরেশতাদের কাছে গৌরব করে থাকেন। তিনি ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসা করেন, হে ফেরেশতারা! কারো উপর কোন কাজের দায়িত্ব দেয়া হলে সে যদি পুরাপুরিভাবে তা পালন করে তবে তাকে কিরূপ প্রতিদান দেয়া উচিৎ ? ফেরেশতারা বলেন,তাকে তার পুরাপুরি পারিশ্রমিক দেয়া উচিৎ।'তখন আল্লাহতায়ালা বলেন,'আমি আমার বান্দা ও বান্দীগনের উপর যে কাজের দায়ীত্ব ন্যস্ত করেছিলাম, তারা যথার্থরুপে তা পালন করেছে। অতঃপর মুসলমানরা যখন দলে দলে দোয়া করতে করতে ঈদগাহের দিকে রওয়ানা হয়, তখন আল্লাহতায়ালা বলেন, ' আমার ইজ্জতের কসম, আমার শান-শওকত ও প্রতিপত্তির কসম, আমি অবশ্যই তাদের দোয়া কবুল করবো।তারপর তিনি তাঁর বান্দা-বান্দীগনের উদ্দেশ্যে ডেকে ডেকে বলেন,'ওহে আমার বান্দা বান্দীগন! আমি তোমাদেরকে মাফ করে দিয়েছি। তোমাদের পাপসমূহকে নেকীতে পরিণত করে দিয়েছি। এবার তোমরা নিজ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন কর।'তখন তারা নিস্পাপ অবˉ’ায় এবং বিপুল পুন্যের অধিকারী হয়ে স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন করে।"

ইসলামের সব কাজই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ও সওয়াবপূর্ণ। তাই মুসলমানরা আনন্দোৎসব পালনের সাথে সাথে নানা প্রকার ইবাদতের মাধ্যমে অশেষ পূণ্যও হাসিল করে থাকে।হাদীসে আছে,'য ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে আল্লাহর সন্তোষ লাভ ও নেকী অর্জনের নিয়তে ইবাদতে জেগে কাটাবে, সেদিন তার অন্তর মরবেনা, যেদিন অন্য সমস্ত অন্তর  মরে যাবে।অর্থাৎ কিয়ামতের দিনের বিভীষিকা দেখে যখন সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত ও আকুল-ব্যাকুল হয়ে পড়বে, তখন ঐ ব্যক্তি সম্পূর্ণ নির্ভয়ে পরমানন্দের মাঝে সময় অতিবাহিত করবে।( ইবনে মাজা; তারগীব)

ঈদুল ফেতরের দিন ১২ টি কাজ  সুন্নত।
১.    সকালে অতি ভোরে ঘুম থেকে ওঠা।
২. মিসওয়াক করা।
৩. গোসল করা।
৪. যথাসম্ভব উত্তম কাপড় পরিধান করা।
৫. শরীয়তের সীমার মাঝে থেকে যথাসাধ্য সুসজ্জিত হওয়া।
৬. খোশবু লাগানো।
৭. ঈদগাহে যাবার পূর্বে সদক্বায়ে ফিতর আদায় করা।
৮. ঈদগাহে যাবার পূর্বেই খুরমা বা অন্য কোন মিষ্ট দ্রব্য ভক্ষণ করা।
৯.  'ঈদের নামায' বিনা ওজরে মসজিদে না পড়ে ঈদগাহে বা ময়দানে পড়া।
১০. ঈদগাহে এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া ও অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা।
১১. ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া।
১২. ঈদগাহে যাবার সময়ে নিম্নলিখিত তাকবীর বলতে বলতে যাওয়া -'আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাললাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।'

দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহ প্রীতি, ধর্মনিষ্ট, সংযমও সাধনার যে পরিচয় দিয়ে থাকে তার বিনিময়ে নগদ ভোগস্বরূপ আল্লাহ পাক দান করেছেন ঈদের মেহমানদারী। ঈদের জিয়াফতে সবাই একসাথে আনন্দ উল্লাস করে। ফিতরা প্রদানের মাধ্যমে গরীবদেরকেও এ আনন্দে অংশগ্রহনের সুযোগ দেয়া হয়।
ঈদের খুশীতে পরস্পরের মাঝে উপহার আদান-প্রদানের মাধ্যমে সম্পর্ক আরো সুন্দর ও দৃঢ় হয়। ঈদেও জাময়াতে মুসলমানদের সম্লিলন অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারনা করে।

ঈদের দিনে ছেলেরা পরস্পর কোলাকুলি করে একে অন্যের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়। একে অপরের জন্য হৃদয়ের হৃদ্যতা ঢেলে দেয়।সম্ভাষন জানায়। সকলের মুখে মুখে ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক।

এ ঈদ মুমিনের জন্য, রোজাদারদের জন্য, আল্লাহর আনুগত্যশীল নেক বান্দাদেও জন্য। দুনিয়ার এ আনন্দ আয়োজনের পাশাপাশি পরকালেও তাদের জন্য রয়েছে অকল্পনীয় প্রতিদান।

নবী  করীম (সাঃ) ঈদের দিনে এতিম বালককে বাসায় এনে গোসল করিয়ে, নতুন জামা পরিয়ে, ভালো খাবার খাইয়ে তার মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। আমাদেরও উচিৎ তাঁর উম্মত হিসেবে তাঁকে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করা।আমরা স্বচ্ছল সবাই যদি আমাদের চারপাশের গরীব-দুঃখী, অনাথ, নিরাশ্রয়ী মানুষের পাশে গিয়ে যে যার সাধ্যমত দাঁড়াই তাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করা ও অভাব মোচনে এগিয়ে যাই, তবে পৃথিবীতে আর কেউ অভাবী থাকবে না, দুঃখী রবে না।পৃথিবীতেই জান্নাতের ও রহমতের সুশীতল বাতাস বইতে থাকবে।

আল্লাহ আমাদেরকে সকল নেক আমল করার ও ছোট-বড় যাবতীয় সকল পাপ ও মন্দ হতে দূরে থাকার তৈফিক দান করুন। এবারের ঈদ যেন হয় আমাদের আপনাদের ও সকলের সম্মিলিত আনন্দের। ঈদ মোবারক।

প্রকাশ: বাংলাবাজার পত্রিকা, ইসলামী ভূবন, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৮, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৯।


৭. ইসলাম ধর্মে সালামের তাৎপর্য / সালামও এক ইবাদত

লেখক ঃ খন্দকার নাজনীন সুলতানা

'আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহ্মাতুল্লাহে ওয়া বারাকাতুহু'। আপনার উপর আল্লাহর অশেষ রহমত বর্ষিত হোক। আপনি সকল প্রকার দুঃখ-কষ্ট, বালা-মসিবত, বিপদাপদ হতে নিরাপদ ও শান্তিতে থাকুন।' কি অপূর্ব সুন্দরতম, হৃদয় প্রশান্তিকর এই দোয়া। প্রতিটি মুসলমান অপর মুসলমানের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ বা আলাপচারিতার প্রারম্ভেই এরূপ সালাম দেয়ার নিয়ম।এটাই ইসলামের বিধান।

ইসলামপূর্ব জাহিলিয়্যাতের যুগে প্রাচীন আরবের অধিবাসীরা পরস্পর মিলিত হলে অভিবাদনস্বরূপ বলতো হাইয়্যাকাল্লাহু। অর্থাৎ আল্লাহ তোমায় দীর্ঘজীবী করুন। পরবর্তীতে ইসলামের প্রারম্ভে মহানবী (সাঃ)-এর মক্কীজীবনের শুরুতে আল্লাহর আদেশে নবী কারীম (সাঃ) সকলকে সালামের আদেশ দেন। তখন থেকেই ইসলামে শুদ্ধ ও সঠিকভাবে সালামের প্রচলন ঘটে।

হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসে পাই, তিনি বলেন- "আমি মহানবী (সাঃ) এর দরবারে হাজির হলে তিনি আমাকে 'আস্সালামু আলাইকুম' বলে অভিবাদন জানালেন। তখন আমি উত্তরে বললাম,ওয়া আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্। অতঃপর হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) বলেন, "ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম যাকে সালাম দেয়া হয়,আমিই সেই ব্যক্তি।" (ফাতহুল বারী, ১১: পৃষ্ঠা ৪)

সালাম একাধারে দোয়া ও ইবাদত। হযরত উমর (রাঃ) হতে বর্নিত এক হাদীসে পাই-'জনৈক ব্যক্তি প্রিয় নবীজী মহানবী (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, ইসলামের সর্বোত্তম আমল কি ? উত্তরে তিনি বললেন, "ক্ষুধার্তদের খাবার খাওয়ানো এবং চেনা-অচেনা সকলকে সালাম দেয়া।" (আবু দাউদ)

আমাদের উচিৎ পরিবারে ও পরিবারের বাইরে বেশি বেশি সালামের প্রচলন করা। নিজেরা পরস্পর সালাম আদান-প্রদান করা এবং অন্যদের সালাম দিতে উৎসাহিত করা। পরিবারে মা-বাবা ও মুরুব্বীদের উচিৎ ছোটবেলা থেকেই শিশুদেরকে শুদ্ধ রুপে ও সঠিক নিয়মে সালাম দেয়ার শিক্ষা দেয়া। অনেকে খুব দ্রুত বলেন, 'স্লামালাইকুম'।এর কোন অর্থ হয় না, তাই এরূপ বলা উচিৎ নয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, "যখন তোমাদেরকে সালাম দেয়া হয়, তখন তোমরা তার চেয়ে উত্তম অথবা অনুরূপ সালাম দ্ধারা তার উত্তর দাও।" (সূরা নিসা, আয়াত নং ৮৬)

সালাম আদান-প্রদানে পরস্পরের প্রতি স্নেহ, মায়া-মমতা ও ভালবাসা সৃষ্টি হয়।এবং উপ¯িহত শ্রোতাদের উপর এর অপরূপ সুন্দর প্রভাব পড়ে।

হযরত আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-"রাসুল কারীম (সাঃ) বলেছেন, সে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক নিকটবর্তী যে প্রথমে সালাম দেয়।"(আহ্মদ, তিরমিযী, আবু দাউদ)

হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-"রাসুল কারীম (সাঃ) বলেছেন, "কথাবার্তা বলার আগেই সালাম দিতে হয়। (তিরমিযী)

শিশুদেরকে সালাম শিক্ষা দেবার উত্তম পন্থা হলো, শিশুদের সাথে দেখা হলে বড়রাই প্রথমে তাদের সালাম দেবেন। কোমলমতি ও অনুকরণপ্রিয় শিশুদের মনে এই ব্যাপারটি দারুণ প্রভাব ফেলবে। এতে শিশুরা খুব দ্রুত সালাম আদান প্রদানে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। নিস্পাপ শিশুরা কচিকন্ঠে যখন সালাম দেবে, তখন শুনতেও অত্যন্ত আকর্ষণীয়, মজদার, ও হৃদয়গ্রাহী হবে। আল্লাহ্ও খুব খুশি হবেন। সালাম আদান-প্রদান "নবী কারীম (সাঃ)-এর আদর্শ ও সুন্নত।

আনাস (রাঃ) হতে বর্নিত এক হাদীসে আছে, " হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) একবার একদল শিশু-কিশোরদের কাছ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন, তখন তিনি তাদেরকে সালাম দিলেন।"(মুসলিম শরীফ ২য় খন্ড)
তাই হযরত আনাস (রাঃ)ও ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের সাথে দেখা সাক্ষাত হলে সালাম দিতেন।

বড়রা উদার মন নিয়ে বিনম্রভাবে হাসতে হাসতে শিশুদেরকে সালাম দিলে শিশুরাও অন্যকে দ্রুত সালাম দিতে অভ্যস্ত হবে। শিশুদের মাঝে ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি জাগ্রত হবে। শিশুদের পক্ষ থেকে বড়দেরকে শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের মন-মানসিকতা সৃষ্টি হবে।

সালাম দেবার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে শিশু সজাগ হবে। পরস্পরের মাঝে দোয়া বিনিময়ের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে।

 শিশুরা কাদামাটির ন্যায় নরম ও কোমল। ওদেরকে শেখানো খুবই সহজ ও ফলপ্রসু। প্রতিটি শিশু যখন সৌজন্যমূলক আচার-আচরণ ও নিয়ম-নীতিতে অভ্যস্ত হবে, তখন পরবর্তী প্রজন্ম খুব সহজেই সঠিক ও নির্ভুল পথে অগ্রসর হতে অভ্যস্ত হবে।

প্রতিটি গৃহ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জনসমাবেশ, অফিস-আদালত সর্বত্রই সালাম আদান-প্রদানে সকলকে উৎসাহিত করা উচিৎ। হযরত কাতাদাহ (রাঃ) হতে বর্নিত হাদীসে পাই, " হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করবে, তখন গৃহবাসীকে সালাম দিবে।  আর যখন বের হবে, তখনও গৃহবাসীকে সালাম দিয়ে বিদায় নেবে।"(বায়হাকী)

ইসলাম ধর্মের সালাম যতটুকু ব্যাপক অর্থবোধক ও মাহাত্মপূর্ণ অন্য কোন ধর্মের স্বাগতম ও আদাব বিনিময়ের মাহাত্ম্য এরূপ নয়। সালামে শুধু ভালোবাসাই প্রকাশ পায় না, বরং আল্লাহর কাছে এই দোয়াও করা হয় যে, আল্লাহ আপনাকে সকল প্রকার দুঃখ-কষ্ঠ, বালা-মসিবত ও বিপদ-আপদ হতে নিরাপদ ও শান্তিতে রাখুক।

সালামে এরূপ অভিব্যক্তিও রয়েছে যে, আমরা সবাই আল্লাহর মুখাপেক্ষী। তাঁর রহমত ব্যতীত আমরা একে অপরের উপকারও করতে পারি না। সালাম এক অর্থে এবাদত এবং অপরদিকে অপর মুসলিম ভাইকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার উপায়ও বটে। আবার সালামের মাঝে এ ওয়াদাও করা হয় যে, আমার হাত ও মুখের অনিষ্ট হতে তুমি নিরাপদ। তোমার জানমাল ও ইজ্জত আবরুও আমি সংরক্ষণ করবো ইনশাআল্লাহ।

সালামের মাহাত্ম্য সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্নিত এক হাদীসে পাই-" হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা ঈমান গ্রহণ করবে। ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমান লাভ করতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন কথা বলবো, যাতে তোমাদের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে ? তোমরা পরস্পরের মাঝে সালামের ব্যাপক প্রচলন করবে। (মুসলিম, আবু দাউদ)

অপর এক হাদীসে নবী কারীম (সাঃ) ইরশাদ করেন,"তোমরা করুনাময় আল্লাহতা'লার ইবাদত কর এবং সালামের ব্যাপক প্রচলন কর।"

আজ থেকে অফিসে আপনার জুনিয়র কর্মকর্তা, কর্মচারী, পিয়ন, দারোয়ান সবাইকে আগেভাগে সালাম দিয়ে দেখুনইনা ওরা কি খুশি হয় ? নিশ্চিত ওরা সবাইকে বলে বেড়াবে যে, আমার বস কি ভালো। এমন ভালো, অমায়িক, হাসিখুশি মানুষ কমই দেখেছি। আরো কত্ত কত্ত প্রসংশা। আরে সালাম দিতে তো আর পয়সা লাগে না, একটু তড়িঘড়ি করে সবার আগে সালাম দিয়ে দেখুনই না। ঠকবেন না ইনশাআল্লাহ্, জিতবেনই। আর বড়দেরকে সালামতো দিতেই হবে। তা না হলে বেয়াদপী হবে যে।

ঘুম থেকে উঠে স্ত্রী বা স্বামীকে প্রথমেই সালাম দিন। দেখবেন, স্ত্রী আপনার উপর অভিমান করে থাকলেও ফিক্ করে হেসে দেবে। এতে স্বামী-স্ত্রীর মিল মহব্বত অনেক বৃদ্ধি পাবে। তখন আপন ঘরেই বেহেশতের সুশীতল বাতাস বইতে থাকবে।

বাসা থেকে অফিসে যাবার সময় বাসার সবাইকে সালাম দিন। দেখবেন বাসার সকলের সারাটি দিন বেশ ভালোই কাটবে। আপনার শিশুও স্কুলে যেয়ে সবার আগে সবাইকে সালাম দেবে। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে সব শিশুরাই আপনার শিশুর বন্ধু হয়ে উঠবে।

কাজেই ছোট-বড় সবাইকে সালাম দিন। অন্যদেরও সালাম দিতে অভ্যস্ত করুন। নিষ্কলুষভাবে, পবিত্রভাবে প্রাণভরে সবাইকে ভালোবাসুন। দেখবেন অন্যরাও আপনাকে কত্ত ভালোবাসে।

হাদীসে আছে, "যে ব্যক্তি সালাম দিতে কার্পণ্য করে সে কৃপণ বলে গণ্য হবে।" অন্য এক হাদীসে আছে, "যে ব্যক্তি প্রথমে সালাম দেয়, সে অহঙ্কারমুক্ত।"

আর অহঙ্কার এমন একটি আবরণ যা মানুষের সকল মহত্ত্ব আবৃত করে ফেলে। বাদশাহ সোলেমান এর কথা-Ñ"অহঙ্কার মানুষের পতন ঘটায়। কিন্তু বিনয় মানুষের মাথায় সম্মানের মুকুট পরায়।" তাই মনের মাঝে বিন্দুমাত্র অহঙ্কারও যদি থাকে তা ত্যাগ করুন ও ছোট-বড় সবাইকে সালাম দিন।

'আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহ্মাতুল্লাহে ওয়া বারাকাতুহু'।

প্রকাশ: দৈনিক ইনকিলাব (ইসলামী জীবন), ১৮ আগস্ট ২০০৯।


৮. ইসলামে নেককার নারীর সম্মান ও মর্যাদা
লেখক ঃ খন্দকার নাজনীন সুলতানা

নারী, তুমি সৃষ্ঠির শ্রেষ্ঠ, অবনীর নীর, যেন গোলাপে গঠিত ভিতর ও বাহির। কত যতœ করে অপূর্ব সুন্দর রুপে অনুপম গুনাবলীতে আল্লাহ নারীকে সৃিষ্ট করেছেন পুরুষের সঙ্গীরুপে। নেককার নারী পরিবার, দেশ-জাতি তর্থ সমগ্র বিশ্বের জন্যই অমূল্য সম্পদ ।

একজন নারী, সে তার সমস্ত দায় দায়ীত্ব সম্পর্কে থাকবে সচেতন। নামাজে একনিষ্ঠ, আল্লাহর প্রতি ভক্তিতে অবনত, নিজের পবিত্রতা রক্ষার্থে সতর্ক, কাজে-কর্মে ইসলামের অনুসারী,মনে-প্রাণে ইসলামী নিয়ম-নীতিতে বিশ্বাসী, ধৈর্যশীলা, ন্যয়নিষ্ট, ঈমানদার, অনুগতা, সত্যবাদী, বিনীতা, দানশীলা, রোজা পালনকারিনী, যৌনাঙ্গ হেফাজতকারিনী আল্লাহর অধিক যিকিরকারিনী তাকেই বলা যায় নেককার নারী । আল-কোরআন ও হাদীসের বর্ননা অনুযায়ী পৃথিবীর সর্বযুগের ও সর্বকালের  সর্বোৎকৃষ্ট নেককার নারীরা হলেন, হযরত মরিয়ম (আঃ), হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ), হযরত আছিয়া (আঃ), হযরত হজেরা (রাঃ), হযরত রহিমা (রাঃ), হাফসা বিনতে উমর ইবনুল খাতাব (রাঃ), ঊম্মুল মোমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ), হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ (রাঃ), হযরত ফাতিমা যোহরা (রাঃ) প্রমুখ।

কন্যা, জায়া, জননী, নানা নামে ভূষিত ও বহুবিধ দায়িত্বে নিয়োজিত এক নারী । কন্যা, বোন স্ত্রী কিংবা মা, নারীর কোন দায়ীত্বের চেয়েই কোন দায়ীত্ব কম নয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী যখন তার স্ব স্ব কাজ ও দায়িত্ব ঈমানের সাথে সূচারুরুপে পালন করতে পারবে, তখনই সে নারী হয়ে উঠবে একজন নেককার নারী, আদর্শ ও অনুকরনীয় ব্যক্তিত্ব ।

আল কোরআন ও হাদীসে নেককার অপরিসীম মর্যাদা ও সম্মানজনক পুরস্কারের কথা ঘোষিত হয়েছে । রাসূলে কারীম (সাঃ) এরশাদ করেন-"কোন মুমিন ব্যক্তির জন্য পরহেজগারীর পর নেককার স্ত্রী অপেক্ষা উত্তম কোন সম্পদ নেই । নেক স্ত্রীর লক্ষণ হলো, (১) যখন তাকে কোন নির্দেশ দেয়া হয়, তা সে পালন করে । (২) স্বামী যখন তার মুখের দিকে তাকায়, তখন সে স্বামীকে আনন্দ দান করে। (৩) যদি তাকে কোন শপথ দেয়া হয়, তবে সে তা পূরণ করে । (৪) স্বামী যদি কখনও বিদেশে চলে যায়, তবে স্বামীর অনুপস্থিতিতে সে নিজের সতীত্ব ও স্বামীর ধন সম্পদ রক্ষা করে।" (ইবনে মাজা)

ধার্মিকা নারীদের ফযিলত সম্পর্কে হযরত ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, নবী কারীম (সাঃ) এরশাদ করেন-"এ বিশ্বমন্ডলের পুরোটাই ভোগসম্ভার ও আনন্দ উল্লাসের সামগ্রী । তম্মধ্যে সর্বোত্তম সামগ্রী হল নেক ও সৎকর্মপরায়ণ নারী।" ( মুসলিম )

বিবাহের জন্য পাত্রী পছন্দের ক্ষেত্রেও নেককার ও দ্বীনদার নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে । এ প্রসঙ্গে হাদীসে পাই, নবী কারীম (সাঃ) এরশাদ করেন-"স্ত্রী লোকের মধ্যে চারটি জিনিসের অনুসন্ধান করা হয় । সম্পদ, বংশ মর্যাদা, সৌন্দর্য ও ধর্মভীরুতা। হে উদ্দীষ্ট ব্যক্তি তুমি কেবলমাত্র ধর্মভীরু নারীকে বিবাহ কর। তোমার হাত    ধূলি-ধূসরিত হোক।" (বোখারী, মূসলিম)

নেককার নারী পরিবার, দেশ-জাতি তথা সমগ্র বিশ্বের জন্যই উপকারী । ধার্মিকা স্ত্রী তার স্বামীকে সর্বদা সৎ পরামর্শের মাধ্যমে সঠিক পথ বাতলে দিয়ে সকল বিপদ থেকে দূরে রাখেন। মহানবী (সাঃ) নেককার স্ত্রীদের  আল্লাহর অনুদান বলে অভিহিত করেছেন। হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্নিত একটি হাদীসে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, মহানবী (সাঃ) এরশাদ করেন-"আল্লাহ যাকে নেককার-দ্বীনদার স্ত্রী দান করেছেন, তাকে ,অর্ধেক দ্বীন দ্ধারা সাহায্য করেছেন। এখন তার কর্তব্য হলো সে 'তাক্বওয়া' ও 'খোদাভীরুতা' দ্ধারা বাকী দ্বীন অর্জন করুক।" (কানযুল উম্মাল ১৬:২৭৩)

নেককার স্ত্রী সর্বদাই স্বামীর ধর্ম-কর্মে সাহায্যকারিনী । ধার্মীকা স্ত্রী স্বামী ও তার পরিবারের জন্য আশীর্বাদস্বরুপ অপর দিকে বদকার স্ত্রী স্বামী, সন্তান ও তার পরিবারের জন্য অভিশাপ স্বরুপ । হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবযী (রাঃ) হতে বর্নিত হয়েছে, নবী কারীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন-"নেককার মহিলা নেককার পুরুষের বিবাহ বন্ধন এমন, যেমন বাদশাহর মাথায় মূল্যবান পাথর খচিত তাজমুকুট। আর নেককার লোকের বিবাহ বন্ধনে বদকার মহিলা এমন যেমন বৃদ্ধ লোকের মাথায় ভারী বোঝা ।” (দুররুল মানসূর ২:১৫২)

পূন্যবান ও সচ্চরিত্রবতী নারীর স্বরূপ সম্পর্কে হযরত উমর (রাঃ) বলেছেন, "নারী জাতি তিন প্রকার-(১) ঐ নারী যে সচ্চরিত্রা, বাধ্যগত, প্রফুল্লামনা, কোমল হৃদয়, অধিক মুহাব্বতকারিনী, অধিক সন্তান প্রসবকারিনী, সর্বাবˉ’ায় স্বীয় স্বামী ও পরিবারের সকলের প্রতি দয়াময়ী । কিন্তু এমন মহিলা কম পাওয়া যায় (২) দ্বিতীয় ঐ নারী, যে পাত্রের মতো (যাতে জিনিস রাখা হয় এবং বের করা হয়।) অর্থাৎ অধিক সন্তান জন্ম দেয়ার উপযুক্ত নয়। (৩) ঐ মহিলা, যে ধোঁকাবাজ, দাগাবাজ, আল্লাহ যাকে চান, তার উপর এমন দুরাচার মহিলা চাপিয়ে দেন, আর যাকে চান, তার উপর থেকে হটিয়ে,দেন।"
(কানযুল উম্মাল ১৬:২৬৩)

দ্বীনদার নারীর ফজিলত অপরিসীম। তাবরানী শরীফে পাই, হযরত আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, মহানবী (সাঃ) এরশাদ করেছেন-"হে নারী জাতি! তোমাদের মধ্যে যারা নেককার, তারা নেককার পুরুষের আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদেরকে গোসল দিয়ে খুসবু মাখিয়ে নিজ নিজ স্বামীর নিকট অর্পণ করা হবে। তখন তারা লাল ও হলুদ বর্ণের বাহনের উপর উপবিষ্ট থাকবে। তাদের সাথে ছড়িয়ে থাকা মুক্তার মত কচি কচি শিশুরা পরিবেষ্টিত থাকবে।" (কানযুল উম্মাল ১৬:৪১২)

সৎ ও আদর্শ নারী এ পৃথিবীর আকর্ষণীয় নিয়ামতসমূহের অন্যতম। এ প্রসঙ্গে হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেন-“এ পৃথিবীর (সমগ্রী) থেকে আমার প্রিয় বানানো হয়েছে নারী ও সুগন্ধি এবং নামাযের মধ্যে আমার চোখের শীতলতা রাখা হয়েছে।” (নাসায়ী শরীফ)

নেককার নারীদের কিয়ামতের মাঠে মহান আল্লাহতা'য়ালা সম্মানিত করবেন। কিয়ামতের দিন ঘোর অন্ধকারে পুলসিরাত পার হবার সময় পূন্যবতী নারীরাও আল্লাহর অশেষ নেয়ামতের নূরের অধিকারী হবেন। এ প্রসঙ্গে আল-কোরআনে মহান আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-“স্বরনীয় সেদিন, যেদিন আপনি দেখবেন, ঈমানদার পুরুষ ও নারীদেরকে, যে তাদের সম্মুখে ও ডান পার্শে¦ তাদের নূর ছুটাছুটি করবে।(তাদেরকে) বলা হবে, আজ তোমাদের জন্য অনন্ত অসীম আনন্দময়  জান্নাতের সুসংবাদ, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত। তাতে তারা চিরকাল থাকবে, এটাই মহাসাফল্য।” (সূরা হাদীদ, আয়াত নং১২)

পবিত্র ও নেক রমনী এই পৃথিবীতে বাহ্যিকভাবে হাজারো সমস্যায় র্জর্জরিত অবস্থায় থাকলেও মানসিক ভাবে চরম ও পরম প্রশান্তিতে জীবন অতিবাহিত করতে পারে আর পরকালে নেক নারীদের জন্য রয়েছে অনাদিকালের অফুরন্ত সুখ-শান্তি ও প্রশান্তি। এ প্রসঙ্গে আল- কোরআনে মহান আল্লাহতা'য়ালা ঘোষণা দিয়েছেন-"যে ব্যক্তি নেক আমল করবে-চাই পুরুষ হোক বা নারী, যদি ঈমানদার হয় তাকে আমি দুনিয়াতে প্রশান্তির জিন্দেগী দান করব এবং পরকালে তাদের আমলের উত্তম প্রতিদানে তদেরকে  পুরস্কৃত করব।" (সূরা নাহল, আয়াত নং ৯৭)

সৎকর্মশীলা ও ঈমানদার নারীদের প্রসঙ্গে পবিত্র, কোরআনের সূরা নিসা ও সূরা ফাতহ-এ আল্লাহতা'য়ালা এরশাদ করেন-"যে কেউ পুরুষ কিংবা নারী কোন সৎকর্ম করে এবং (আল্লাহতে) বিশ্বাসী হয়, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রাপ্য তিল পরিমাণও নষ্ট করা হবে না।" (সূরা নিসা, আয়াত নং ১২৫)

তিনি (আল্লাহ) ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করান, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, সেথায় তারা চিরকাল থাকবে এবং আল্লাহ তদের পাপ মোচন করবেন। এটাই আল্লাহর কাছে তাদের প্রাপ্য মহাসাফল্য।" (সূরা আল ফাতহ, আয়াত নং ৫)

সৎকর্মশীল নেককার ও দ্বীনদার নারীদের ফজিলত সম্পর্কে হযরত উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত এক হাদীসে পাই, "নেক ও সৎকর্মপরায়ণ একজন মহিলা এক হাজার বে-আমল পুরুষ হতে ঊত্তম।" (আনীসুল ওয়ায়েমীন)

অপর এক হাদীসে নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “নিশ্চয় পৃথিবীর নেকবখত নারীগণ জান্নাতের মাঝে সত্তর হাজার আনত নয়না রূপসী হুরদের চেয়েও উত্তম হবে।” (আত তাযকিরা: ৫৫৬)

ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে এ প্রসঙ্গে বর্ণিত এক হাদীস হতে পাই মহানবী (সাঃ) এরশাদ করেন-"জান্নাতে প্রবেশের সময় সবচেয়ে অগ্রগামী ঐ সমস্ত মহিলাগণ হবেন, যারা দ্বীনের ব্যাপারে অগ্রগামীনী।" (মুসনাদে আহমদ ২:৬৬)

সতী নারী সর্বাবস্থায় অবশ্যই তার সতীত্ব রক্ষা করে চলবে। কারণ একজন নারীর জন্য সতীত্বের চেয়ে বড় সম্পদ আর নেই। আর হাজার প্রতিকূলতা  সত্ত্বেও সওয়াবের আশায় যে নারী সতীত্ব রক্ষা করে চলবে কেয়ামতের মাঠে সে শহীদদের অর্ন্তভূক্ত হবে। এ প্রসঙ্গে ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত এক হাদীসে পাই, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন-“নিশ্চয় আল্লাহতা’আলা নারীদের উপর সতীত্ব সংরক্ষণবোধ ফরজ করেছেন। যেমন পুরুষদের উপর জেহাদ ফরজ করেছেন। অতঃপর তদের মধ্যে যে ঈমান ও সওয়াবের আশায় (সতীত্ব রক্ষা করত) ধৈর্য্য ধারণ করবে সে শহীদদের সওয়াব পাবে।” (কানযুল উম্মাল, ১৬:৪০৭)

“ইসলামে নেককার, ঈমানদার ও পবিত্র নারীদেরকে মহান আল্লাহ পুরুষের পাশাপাশি সকল প্রকার প্রাপ্য হকসমূহ সুনিশ্চিত করেছেন এবং উপযুক্ত সারিতে যথার্থ সম্মান ও মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন । এ প্রসঙ্গে আল-কোরআনে বলা হয়েছে-"নিশ্চয় মুসলমান পুরুষ ও মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী, অনুগত  পুরুষ ও অনুগতা নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীলা পুরুষ ও ধৈর্যশীলা নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীতা নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীলা নারী, রোযা-পালন কারী পুরুষ ও রোযা-পালন কারিনী নারী, যৌনাঙ্গ হিফাজতকারী পুরুষ ও যৌনাঙ্গ হিফাজতকারিনী নারী, আল্লাহর অধিক যিকিরকারী পুরুষ ও আল্লাহর অধিক যিকিরকারিনী নারী তাদের জন্য প্রস্তত রেখেছেন মহান আল্লাহ ক্ষমা ও মহা পুরস্কার।” (আল আহযাব, আয়াত নং-৩৫)

ইসলাম পবিত্র নারীদের যতটুকু মর্যাদা ও সম্মান প্রদান করেছেন  অন্য কোন ধর্ম বা মতবাদ তার কিঞ্চিতও প্রদান করতে পারেনি । অনেকক্ষেত্রে ইসলাম পুরুষদের চেয়েও নারীদের বেশী মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে একটি হাদীসে উল্লেখ করা যায়- “জনৈক সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সাঃ)- এর কাছে আরজ করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ আমি কার সাথে সর্বাধিক সদ্ব্যবহার করব? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উত্তরে বললেন, তোমার মায়ের সাথে। অতঃপর জিজ্ঞেসা করলেন তারপর কার সাথে ? নবী করীম (সাঃ) বললেন তোমার মায়ের সাথে। পুনরায় সাহাবী জিজ্ঞেস করেন তরপর কার সাথে? প্রিয় নবী (সাঃ) এবারও উত্তর দিলেন 'তোমার ময়ের সাথে'। এরপর ৪র্থ বার প্রশ্ন করলেন তারপর কার সাথে ? তখন প্রিয় নবী (সাঃ) উত্তর দিলেন 'তোমার পিতার সাথে' এবং এরপর অন্যান্য নিকট থেকে নিকটতম আত্মীয়ের সাথে।” (তিরমিজী ২:১১)

উক্ত হাদীস অধ্যয়নে বোঝা যায় যে, নবী করীম (সাঃ) পিতার তুলনায় মাকে তিনগুণ অধিক মর্যাদার অধিকারিনী বলে ঘোষনা করেছেন। রাসূলে আকরাম (সাঃ) অন্যত্র এরশাদ করেন-"নেককার স্ত্রী, যে স্ত্রী ঈমানে সাহায্যকারী সে একজন মুসলমানের জন্য পরম সম্পদ।"  (তিরমিযী)

নেক নারীদের মর্যাদা সম্পর্কে নবী করীম (সাঃ) আরো এরশাদ করেন- "নেককার স্ত্রী, উৎকৃষ্ট বাসস্থান এবং ভাল যানবাহন লাভ করা মানুষের সৌভাগ্য। আর দুশ্চরিত্রা স্ত্রী, মন্দ বাসস্থান ও খারাপ যানবাহন লাভ করা মানুষের দুর্ভাগ্য।"

ধামীর্কা, নেক ও সৎ নারীদের পরকালীন সম্মান সম্পর্কে উম্মুল মোমিনীন হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) থেকে বর্ণিত অপর হাদীস হতে পাই, তিনি বলেন-"আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ ! দুনিয়ার (দ্বীনদার) নারীগণ কি আনতনয়না হুরদের চেয়ে উত্তম ? নবীজী (সাঃ) এরশাদ করেন, দুনিয়ার (দ্বীনদার) নারীগণ সুন্দরী হুরদের চেয়েও উত্তম। যেমন কাপড়ের উপরের পিঠ ভিতরের পিঠ থেকে উত্তম।"

অর্থাৎ ইহকাল ও পরকাল সকল সময়েই নেককার নারীর জন্য রয়েছে আল্লাহর সুদৃষ্টি, খাস রহমত ও নেয়ামতে ভরা অফুরন্ত পুরষ্কার। তাই আসুন মা-বোন কন্যা ও স্ত্রী সকল নারীরা আমরা সবাই সত্য- মিথ্যার তফাৎ বুঝে, সঠিক আদর্শে পথ চলতে শিখি। ইসলামী ন্যায়-নীতি আদর্শ অনুকরণ ও অনুসরণ করে হয়ে যাই - কোরআনে বর্ণিত জান্নাতী রমনীদের ন্যয় দ্বীনদার ও নেককার বান্দা। দ্রুত নিজেকে গড়ে তুলি অনুকরণীয় আদর্শ ব্যক্তিত্বরুপে।

আমরা নারীরা কেবল নারী হয়েই পথ চলবো। কোরআন ও হাদীসে বণির্ত নারীর কর্তব্য ও দায়-দায়ীত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবো । সম-অধিকার নয়, আমাদের প্রয়োজন আল-কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত নারীর অধিকারসমূহের যথার্থ ও সঠিক বাস্তবায়ন। আমাদের সকল স্বপ্ন সার্থক হোক। পথ-চলা হোক সুন্দর। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।

প্রকাশঃ দৈনিক ইনকিলাব, (ইসলামী জীবন), ৮ ও ১০ নভেম্বর, ২০০৯।


৯. শবেবরাতে করনীয় ও বর্জনীয়/
শবেবরাত একটি মহিমাময় রজনী

লেখক ঃ খন্দকার নাজনীন সুলতানাশাবনের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত এবং ১৫ই শাবানের পূর্বের রাতকে বলে লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত। অর্থাৎ নাজাতের রাত। ‘শব’ অর্থ রাত ‘বারাআতুন’ অর্থ নাজাত-নিস্কিৃতি। তাই এই রাতের নাম ‘লাইলাতুল বারাআত’ বা ‘শবে বারাআত’। সংক্ষেপে ‘শবে-বরাত।’

হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, শবে বরাতের রাতে সারা বছরের হায়াত, মওত, রিজিক ও দৌলত লেখা হয় এবং বান্দাদের আমল ঐ রাতে আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়।
রাসূল (সাঃ) উম্মতদের উপদেশ দিয়েছেন যে, “শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতে তোমরা জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদত করো এবং দিনে রোজা রেখো।”

শবে-বরাতের মাহাত্ম অপরিসীম।
 এ রাতে বান্দার প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত বর্ষিত হয়।
 আল্লাহর দরবারে বান্দার আমলসমূহ পেশ করা হয়।
 এ রাতে বিশেষ ধরনের অপরাধী ছাড়া বাকী সবাইকে মাফ করে দেয়া হয়। কিন্তু মন-প্রাণ থেকে তওবা না করা পর্যন্ত কিছু অপরাধীকে কখনই মাফ করা হয় না। তারা হলো-মুশরিক, জাদুকর, গণক, ইর্ষাপরায়ণ, অন্যের হক নষ্টকারী, গায়ক, বাদক, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছেদকারী, পরস্পরে শত্র“তা পোষণকারী, অত্যাচারী শাসক ও তাদের সহযোগী, মিথ্যা শপথ করে পন্য বিক্রয়কারী, গর্ব সহকারে পায়ের গিরার নীচে কাপড় পরিধানকারী, মদ্যপ, পরস্ত্রীগামী, মা-বাবার অবাধ্য সন্তান, কৃপন পরনিন্দাকারী, জুয়া খেলোয়ার ইত্যাদি।

অর্থাৎ কবীরা গোনাহ সমূহ বিনা তওবায় মাফ হয় না আর ছোট-খাট বা সগীরা গোনাহ সমূহ শবে-বরাত, শবে-কদর প্রভৃতি মহিমান্বিত রাতের বরকতে মাফ হয়।

 এ রাতে জমজমের পানি সুমিষ্ট হয়।
আল্লাহ প্রতি রাতেরই শেষ তৃতীয়াংশে পৃথিবীর আসমানে শুভাগমন করেন। কিন্তু শবে বরাতের রাতে মাগরিবের সময় হতে ফজর পর্যন্ত আল্লাহ বান্দার ফরিয়াদ শোনার জন্য অপেক্ষা করেন। এ জন্যই ’শবে বরাত’ স্বমহিমায় অনন্য।

আয়শা সিদ্দীকা (রাঃ) হতে বর্ণিত এক হাদীসে আছে “একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রাত্রিতে তাহাজ্জুদের নামাজ আরম্ভ করলেন। যখন তিনি সেজদা করলেন, তখন এত দীর্ঘ সময় সেজদাতে রইলেন যে, আমি আশংকা করতে লাগলাম হয়ত তার প্রাণ বায়ু বের হয়ে গিয়েছে। আমি বিচলিত হয়ে তাঁর নিকটে গিয়ে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলী ধরে নাড়া দিলাম। তাতে তিনি নড়ে উঠলেন। আমিও নিশ্চিন্ত হয়ে নিজ স্থানে চলে গেলাম। নামাজ শেষ করে তিনি কয়েকটি কথা বলার পর এরশাদ করলেন-‘হে আয়শা আজ কোন রাত্রি তা তুমি জান কি? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রসূল অধিক জ্ঞাত। তিনি বললেন, আজ ১৫ই শা’বানের  রাত্রি (শবে-বরাত)। এ রাত্রিতে আল্লাহ পাক দুনিয়াবাসীদের প্রতি কৃপাদৃষ্টি করেন। যারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন তাদেরকে ক্ষমা করেন। যারা তাঁর দয়া ও করুনা চায়, তাদের প্রতি করুনা বর্ষন করেন। কিন্তু পরস্পর শত্র“তাকারী এ রহমত হতে বঞ্চিত হয়। এ রাত্রিতে বিশ্ববাসীর তকদীর সম্বন্ধীয় যাবতীয় বিষয়ের নথিপত্র কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে ফেরেশতাগনের কাছে সোপর্দ  করা হয়। যাতে জন্ম, আয়ু, রিজিক, সম্মান, জয়-পরাজয়, সুখ-অসুখ, দুর্যোগ, উত্থান-পতন ইত্যাদি বিষয় সন্নিবেশিত থাকে।”

অপর এক হাদীসে আছে, "আয়েশা (রাঃ) রাসূল (সাঃ) কে প্রশ্ন করেছিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এ রাতে কি আছে? তিনি এরশাদ করলেন, পরবর্তী বছর যেসব সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে, ওদের নাম এ রাতে তালিকাভুক্ত করা হয়। যে সকল আদম সন্তান এ বছর মৃত্যুবরণ করবে, তাদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। (লওহে মাহফুজে মানুষের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছু বহু পূর্বেই লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ রাতে এ বছরের কপি সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাদের হাতে অর্পণ করা হয়।) বনী আদমের আমলসমূহ আল্লাহর কাছে পাঠানো হয়। এ রাতে সকলেরই জীবিকা নির্ধারণ হয়।

হাদীসে আছে, "আয়েশা (রাঃ) রাসূল (সাঃ) কে প্রশ্ন করেছিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর রহমত ছাড়া কেউ বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না? রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করলেন, না কেউ আল্লাহর রহমত ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আপনিওকি আল্লাহর রহমত ছাড়া বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবেন না? রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘আমিও না যদি আল্লাহর রহমত আমায় আবৃত করে না লয়।"

এ পবিত্র রাতের মাহাত্মকে পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে চাইলে পূর্ব হতেই দেহ ও মন শুদ্ধ ও পবিত্র করে নিতে হবে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সবার হক আদায় করে দিতে হবে। কারো সাথে কোন অন্যায় করে থাকলে মাফ চেয়ে নিতে হবে।

অন্তরকে কলুষমুক্ত করে ভক্তি, আশা ও ইয়াকীন সহকারে মনকে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর গোলামীতে সঁপে দিতে হবে। যাবতীয় কাজে আচার-অনুষ্ঠানের চেয়ে এখলাসের দিকে বেশী নজর দিতে হবে এবং আল্লাহকে মন-প্রাণ থেকে গভীর ভাবে ডাকতে হবে। যেন আল্লাহ তা খুব দ্রুত গ্রহণ করে নেয়।

শবে বরাতে কিছু কিছু কর্মকান্ড বর্জন করা আবশ্যক। যেমনঃ আতশবাজী, প্রয়োজনাতিরিক্ত আলোকসজ্জা, গোরস্থানে মেলা ও উৎসব করা, এবাদতকে বাহ্যিক চাকচিক্য ও জাকজমকের দ্বারা অনুষ্ঠান সর্বস্ব বিষয়ে পরিণত করা।

যখন কোন কওম স্বীয় কর্মশক্তি ও ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে, তখন সে কওম এর লোকেরা কাজের চেয়ে প্রদর্শনীকে বেশী ভালোবাসে। ইদানিং আমরা দ্রুত সেদিকেই ধাŸমান হচ্ছি।

আতশবাজি এমন একটি কাজ যাতে দুনিয়া বা আখেরাতের কোন ফায়দা নেই। কেবল আছে অপব্যয় ও অপচয়। আর বিধর্মীদের অনুকরণ। ছেলেমেয়েদেরকে বুঝিয়ে বলতে হবে, যেন তারা আতশবাজি হতে সম্পূর্ণ বিরত থাকে।

হাদীসে আছে, আল্লাহর কোন নেক বান্দা যেন তার প্রতিবেশীকে অভূক্ত রেখে ঘুমুতে না যায়। তাই আমাদের উচিত শবে-বরাত সহ সারা বৎসরই পাড়া প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের খোঁজ-খবর নেয়া। গরীবদের সবসময়ই সামর্থ অনুসারে খাওয়ানো এবং অভাব অনটনে তাদের সাহায্য সহযোগীতা করা। 

শবে-বরাতে অত্যাধিক আলোকসজ্জা উচিৎ নয়। নিঃসন্দেহে এ দিনটি মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের দিন। তবে আলোকসজ্জার দ্বারা এ আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো ইসলাম কতটুকু সমর্থন করে সে বিষয়টি আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। অপচয়কারী শয়তানের ভাই। অতিরিক্ত আলোকসজ্জা নিঃসন্দেহে একটি অপচয়। আর একটি কুসংস্কার হলো কবরস্থানে মেলা বসানো ও কবরে বাতি জ্বালানো।

বাচ্চা ও ছোটদের বোঝাতে হবে ওরা যেন মসজীদে যেয়ে হট্রোগোল না করে। এতে মসজীদের আদব ও পবিত্রতা নষ্ট হয়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মসজীদে যেয়ে দৌড়াদৌড়ি ও ছুটাছুটি করলে অন্যদের এবাদত বন্দেগীতে বিঘœ ঘটে। এতে সওয়াবের বদলে গুনাহের অংশীদার হতে হয়। অনেক সময় অন্যের বিরক্তি ও বদদোয়ায় পড়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়।

শবে-বরাতে কত বেশী নামাজ পড়লাম সেটা মুখ্য বিষয় নয়। কতটা একাগ্রতা ও এখলাসের সাথে আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারলাম সেটাই মুখ্য বিষয়। মহব্বতের সাথে সামান্য পরিমাণ এবাদত গািিফলতি সহকারে অসংখ এবাদত বন্দেগী হতে শ্রেয় ও পছন্দনীয়। হাদীসে আছে, "তোমরা ঈমানকে খাঁটি কর। অল্প আমলেই নাজাদের জন্য যথেষ্ট হবে।"

নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, "তোমাদের সাধ্যানুসারে নফল এবাদতের দায়িত্ব গ্রহণ কর। যেহেতু আল্লাহতা’য়ালা পুরস্কার দানে নিরস্ত হন না, সে পর্যন্ত তোমরা ক্লান্ত হয়ে কাজে ক্ষান্ত না দাও।"

আমাদের মনে রাখতে হবে, শবে-বরাতে আল্লাহকে পেতে হলে সারাবছরই নামাজ-রোজা এবাদত বন্দেগী করে আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্ক তৈরী করতে হবে। সারাবছরে মাটির সিক্ত রস ও মুক্ত বাতাসে যে বৃক্ষ বেঁচে থাকে, বসন্তে সে বৃক্ষই ফুলে ফুলে সজ্জিত হয়। শরীরে ময়লা থাকলে তা ধুয়ে মুছে পরিস্কার না করলে অধিক সুগন্ধীযুক্ত আতরই কি কোন কাজে আসবে? আল্লাহর অবাধ্যতা পরিহার করে তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনই শবে-বরাতের মূলকথা।

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসে আছে যে, নবী করীম (সাঃ) একটি দোয়া তাঁকে শিখিয়েছেন এবং অন্যকেও শিক্ষা দেয়ার জন্য বলেছেন এবং নামাজের সেজদায় বারবার একটি দোয়া পাঠ করার উপদেশ দিয়েছেন। নবী করীম (সাঃ) এভাবে দোয়াটি পড়তেন,  “হে আল্লাহ! আমার কল্পনা, আমার অন্তর তোমাকে সেজদা করছে। আমার মন তোমার দরবারে সেজদারত অবনত। হে আল্লাহ! তুমি জান আমি নিজে নিজের উপর অত্যাচার করেছি। হে মহান, হে শ্রেষ্ঠতম! তুমিই যাবতীয় মহান কার্যাবলীর ভরসাস্থল। আমার পাপ মার্জনা কর! হে আল্লাহ আমি আমার ললাট দ্বারা সেজদা করেছি। যে ললাটের তুমিই চিত্রকর। তুমিই স্রষ্ঠা। হে আল্লাহ! তুমিই কান ও নয়ন দান করেছ। এ পর্যন্ত বলে সেজদা হতে মাথা তুললেন এবং পুনরায় সেজদায় নতশির হয়ে বলতে লাগলেন,‘হে আল্লাহ! তোমার ক্রোধ হতে নিস্তার চাই। তোমার সন্তুষ্টি প্রার্থনা করি। তোমার শাস্তি হতে পরিত্রাণ চাই। তোমার মার্জনা ও করুনা ভিক্ষা করি। হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয়প্রার্থী, আমি তোমার প্রচুর গুণ-কীর্তন করছি। যেরুপ তুমি নিজেই নিজের গুণ বর্ণনা করছো। আর তোমার ভাই দাউদ (আঃ) যেরুপ দোয়া করেছিলেন আমি তদ্রুপ দোয়া করছি। হে আল্লাহ! আমাকে এরুপ অন্তর দান কর যে অন্তরে শিরকের কণা পরিমান চিহ্ন না থাকে। যে অন্তর পাপকার্য, ফাসেকী ও কঠোরতা হতে উর্ধ্বে থাকে।”

হাদীসে আরো বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি যিলহজ্জ মাসের আট, নয় তারিখ, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহার রাত্রি এবং শবে-বরাত এই পাঁচটি রজনীতে জাগ্রত থেকে এবাদত করবে, তার জন্য জান্নাতে প্রবেশ করা ওয়াজিব হয়ে যাবে।
আল্লাহ আমাদেরকে সকল নেক আমল করার তৈফিক দান করুন। আমীন।

প্রকাশঃ দৈনিক ইনকিলাব (ধর্ম-দর্শন), ১৪ আগষ্ট, ২০০৮।


১০. ইসলামে নারীর পর্দা

লেখক ঃ খন্দকার নাজনীন সুলতানা
লজ্জাই নারীর ভূষণ।যে নারী যত বেশী পর্দায় থাকবে তার মর্যাদাও তত বেশী।উলঙ্গ নারী মূল্যহীন। ইদানিং উঠতি বয়সের মেয়েদের দিয়ে নাটক, সিনেমা বানানোর কৌশলে মেয়েদের করা হচ্ছে পর্দাহীন। ফ্যশন শো, মডেলিং, সুন্দরী প্রতিযোগিতা- এসবের আয়োজনের মাধ্যমে প্রায় উলঙ্গভাবে নারীকে প্রদর্শনী করে মূলত তাদের বানানো হচ্ছে পণ্য।

উলঙ্গ হয়ে নিজেদের দৈহিক সৌন্দর্য প্রদর্শনী করে নারীরা এখন নিলামে উঠেছে। এর ফলাফল ব্যক্তি, দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।তাই পর্দা রক্ষার তাগিদে এবং অন্যদের পর্দায় উৎসাহিত করার লক্ষ্যে মেয়ে, মা, বোন, শাশুড়ি, দাদী-নানী, সকলেরই কোরআন হাদীসে বর্ণিত পর্দা সংক্রান্ত পূর্ন এবং নিভূল জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

পর্দা  নারীর মৌলিক অধিকার। পর্দাতেই নারী সর্বাধিক নিরাপদ। নারীকে নিরাপদে রাখতে পারলে তখন ব্যক্তি, দেশ, জাতি ও সমাজ, সংসার সবকিছুই নিরাপদ। প্রতিটি নারীরই উচিত উঠতে-বসতে, কাজেকর্মে, কথায়-আলাপে সর্বদাই পূর্ন পর্দা রক্ষা করে চলা। শুধু বাহ্যিক পর্দা নয়, অভ্যন্তরীণ পর্দা রক্ষা করাও আবশ্যক।দেহ ও মনে পূর্ণ পর্দা রক্ষা করার মাধ্যমেই নারী হয়ে উঠবে অপরূপ সুন্দরী, নিস্পাপ, নির্ভেজাল, নিস্কলুষ।

আল-কোরআনে পর্দা সংক্রান্ত প্রায় ১৭ টির অধিক আয়াত আছে।এসব আয়াতে মানুষের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় পর্দা সংক্রান্ত আলোচনা এসেছে । একটি মানুষের চোখ-হাত-পা-মন-শরীর প্রতিটি অঙ্গ প্রতঙ্গকেই পর্দায় রাখতে হবে।কারণ সবকিছু মিলিয়েই পূণাঙ্গ একটি মানুষ। মানুষের প্রতিটি অঙ্গপ্রতঙ্গ যখন পবিত্র থাকবে তখন মানুষও হবে পবিত্র। পূর্ণপবিত্র থাকতে চাইলে প্রথমে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধ করতে হবে।তারপর বন্ধ করতে হবে প্রতিটি অঙ্গপ্রতঙ্গের জেনা।

এ প্রসঙ্গে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ঘোষণা করেছেন, "দুই চোখের জেনা হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে আসক্তির সাথে বেগানা পুরুষকে দেখা, তার কথা শ্রবন করা হচ্ছে দুই কানের জেনা। জিহ্বার জিনা হচ্ছে অপরিহার্য প্রয়োজন ব্যতীত বেগানা পুরুষের সাথে কথা বলা, গল্প-গুজব করা। হাতের জিনা হচ্ছে বেগানা বেগানায় আদান-প্রদান করা, করমর্দন করা। পায়ের জিনা হচ্ছে বেগানার সাক্ষাতে হেঁটে যাওয়া।অন্তরের জিনা হচ্ছে জিনার প্রতি আসক্তি প্রকাশ করাও আকাক্সক্ষা করা। প্রকৃত জিনার বাস্তব সত্যরূপ দিবে গুপ্ত অঙ্গ।"

আসুন কন্যা-মা ও বোনেরা আমরা সকল অঙ্গের জিনা হতে বিরত থাকি। জিনার ভয়ানক ও মারাত্মক শাস্তি হতে মুক্তি লাভ করি।মেয়েদের উচিত নয় বেপর্দায় ঘর হতে বের হওয়া।কারণ বেপর্দা নারীর জন্য অনেক বিপজ্জনক।এ প্রসঙ্গে সূরা আহযাব-এর ৩৩ নং আয়াতে আল্লাহ নারীদের সতর্ক করে বলেছেন যে-  "তোমরা নিজেদের ঘরের অভ্যন্তরে অবˉ’ান কর এবং জাহিলিয়াতের যমানার নারীদের ন্যায় নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বের হয়ো না।"

মহিলারা পর্দার আড়াল থেকেই প্রয়োজনীয় বস্তু আদান-প্রদান করবে এটাই যুক্তিসঙ্গত এবং উপকারী।এর মাঝেই যাবতীয় কল্যাণ নিহিত।এ প্রসঙ্গে আল কোরআনের ঘোষণা-"যখন তোমরা (পুরুষরা) মহিলাদের কাছে জরুরী কিছু চাইতে মনস্থ কর তখন পর্দার আড়াল থেকে চেয়ে নাও।এটা তোমাদের এবং তাদের মনের জন্যে অধিকতর পবিত্র উপায়।"(সূরা আহযাব। আয়াত নং-৫৩)

পর্দার অভাবে নারীরা আজ সমাজে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, অবহেলিত ও অনেক ক্ষেত্রে ঘৃনার বস্তুতেও পরিণত হয়েছে। শুধু আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি করে একটি মেয়ের  পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব নয়। নারীর নিরাপত্তা রক্ষার্থে  প্রথমে নারীর নিজেকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। দেহ ও মনে নারী-পুরুষ সবাইকেই থাকতে হবে পূর্ণ পর্দায়।

হাদীসে আছে, ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন-"মহিলারা হল পর্দায় থাকার বস্তু। সুতরাং তারা যখন (পর্দা উপেক্ষা করে) বাইরে আসে তখন শয়তান তাদের (অন্য পুরুষের চোখে) সুসজ্জিত করে দেখায়।"(তিরমিযী)

সরকার অনেক চেষ্টা-তদবির আর আইন প্রণয়ন করেও নারী নির্যাতন বন্ধ করতে পারছে না। কারণ দুধের বাটি সামনে রেখে ক্ষুধার্ত বিড়ালকে নসিয়ত করে লাভ কি? নারী জাতির নিজেদের প্রতিরক্ষাব্যুহ নিজেদেরই তৈরী করতে হবে। প্রতিরক্ষার এই অস্ত্রটি খুবই সুলভ সস্তা ও কার্যকরী। আর তা হলো নারীর পর্দা রক্ষা।

মেয়েরা প্রয়োজনে মুখমন্ডল, হাতের ও পায়ের পাতা খুলতে পারে। এছাড়া মেয়েদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গই পর্দায় ঢাকতে হবে।এ প্রসঙ্গে সূরা আহযাব-এর  ৫৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে- "হে নবী তোমার ˉ¿ীগণ, কন্যাগণ এবং মুমিন মহিরাদের বলে দাও, তারা যেন নিজেদের উপর নিজেদের চাদরের আঁচল ঝুলিয়ে দেয়। এতে তাদের চিনতে পারা যায়। ফলে তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।"

হাদীসে আছে, নবী করীম (সাঃ)-এর শ্যালিকা হযরত আসমা বিনতে আবু বকর (রাঃ) একবার মিহি কাপড় পরে তার সামনে এলেন। কাপড়ের ভেতর দিয়ে তার অঙ্গপ্রতঙ্গ দেখা যাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে নবী করীম (সাঃ) বললেন,  "হে আসমা সাবালিকা হওয়ার পর ইহা এবং ইহা ছাড়া শরীরের কোন অংশ ˉ¿ী লোকের পক্ষে দেখানো জায়েজ নেই।'এই বলে নবী করীম (সাঃ) তার মুখমন্ডল এবং হাতের কব্জির দিকে ইঙ্গিত করলেন।"(ফাতহুল কাদীর)

মুসলমান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই পর্দা পালন নামাজ-রোজার মতোই ফরজ। উ¤মূল-মুমেনীন হযরত সালমা (রাঃ) হতে বর্নিত, একদা তিনি এবং হযরত মায়মুনা (রাঃ) রসূল (সাঃ)-এর কাছে বসেছিলেন। হঠাৎ সেখানে ইবনে উম্মে মাকতুত এসে প্রবেশ করলেন। হুজুর (সাঃ) হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) ও মায়মুনা (রাঃ)-কে বললেন,  তোমরা (আগুন্তক) লোকটি থেকে পর্দা কর। আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী (সাঃ) লোকটি তো অন্ধ, আমাদেরকে দেখতে পাচ্ছে না । তখন রসূল (সাঃ) বললেন, তোমরা দু’জনও কি অন্ধ যে, তাকে দেখতে পাচ্ছ না? (আহমেদ তিরমিযী আবু দাউদ)


মেয়েদের পর্দা রক্ষা এতই জরুরী যে, নিজের কাছে প্রয়োজনীয় কাপড় না থাকলে অন্যের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে হলেও পূর্ণ পর্দা রক্ষা করতে হবে।


এ প্রসঙ্গে এক হাদীসে আছে, "এক মহিলা বললো, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের মধ্যে যদি কারো চাদর না থাকে, তবে কিভাবে বের হবো? এ প্রসঙ্গে নবী করীম (সাঃ) বললেন, 'তার সাথী নিজ জিলবাব দ্বারা তার শরীরের উপর জড়িয়ে তাকে ঢেকে দেবে।"

হাফসা বিনতে আবদুর রহমান একদা সূক্ষ্ম দোপাট্টা পরে হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর ঘরে হাজির হলেন। তখন তিনি তা ছিঁড়ে ফেলে একটি মোটা চাদর দিয়ে তাকে ঢেকে দিলেন।-(মুয়াত্তা ইমামা মালিক)

পর্দার দ্বারাই নারী তার শারীরিক ও আত্মিক মানমর্যাদা পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করতে পারে। সূরা আরাফ-এর ২৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,  "হে আদম সন্তান, আমি তোমাদের জন্য পোশাক নাজিল করেছি, যেন তোমাদের দেহের লজ্জাˉ’ানসমূহকে ঢাকতে পারো। এটা তোমাদের জন্য দেহের আচ্ছাদন ও শোভাবর্ধনের উপায়। সর্বোত্তম পোশাক হলো তাকওয়ার পোশাক। উহা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি উজ্জল নিদর্শন। সম্ভবত লোকেরা উহা হতে শিক্ষা গ্রহণ করবে।"

পর্দা পালনের ব্যাপারে কোন মুসলমানের মনেই সংশয় থাকা উচিত নয়। নারীদের কন্ঠের  ও পর্দা রক্ষা করা আবশ্যক।এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের সূরা আহযাবের ৩২ ও ৩৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, "তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সাথে মোলায়েম স্বরে কথা বলো না। কেননা এতে রুগ্ন অন্তর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের লালসার উদ্রেগ হতে পারে। নিজেদের ঘরে থাক। নামাজ কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য কর। আল্লাহ চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের পরিপূর্ণরুপে পবিত্র রাখতে।

সৃষ্টির আদিকাল হতেই পর্দা রক্ষার প্রতি আল্লাহতায়ালার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। শয়তান সর্বদাই আদম সন্তানের পর্দা নষ্ট করায় ব্যতিব্যস্ত থাকে। মিথ্যা কথা বলে, মিথ্যা ওয়াদা দিয়ে নারী-পুরুষের লজ্জাস্থান পরস্পরের কাছে উন্মুক্ত করে দেয়।

যে বা যারা পর্দা পালন করে না তারা শয়তানকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করেছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের সূরা আ’রাফের ২০, ২২ ও ২৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, "অতঃপর শয়তান তাদের দু’জনকেই কুমন্ত্রণা দিলো যেন সে তাদের নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহ , যা তাদের পরস্পরের কাছ থেকে গোপন করে রাখা হয়েছিল, প্রকাশ করে দিতে পারে। সে তাদের আরো বললো, তোমাদের মালিক তোমাদের এ গাছটির কাছে যাওয়া থেকে তোমাদের যে বারণ করেছেন, তার উদ্দেশ্য এছাড়া আর কিছুই নয় যে, সেখানে গেলে তোমরা উভয়েই ফেরেশতা হয়ে যাবে। অথবা এর ফলে তোমরা জান্নাতে চিরˉ’ায়ী হয়ে যাবে"(আল আ’রাফ, আয়াত নং-২০)

এভাবে সে তাদের দ’ুজনকেই প্রতারণার জালে আটকে ফেললো। অতঃপর এক সময় যখন তারা উভয়েই সে গাছ ও তার ফল আস্বাদন করলো, তখন তাদের লজ্জাˉ’ানসমূহ তাদের উভয়ের সামনে খুলে গেলো। সাথে সাথে তারা জান্নাতের কিছু লতাপাতা নিজেদের উপর জড়িয়ে নিজেদের গোপন ˉ’ানসমুহ ঢাকতে শুরু করলো; তাদের মালিক তখন তাদের ডাক দিয়ে বললেন, আমি কি তোমাদের উভয়কে এ গাছটির কাছে যেতে নিষেধ করিনি এবং আমি কি তোমাদের একথা বলে দেইনি যে, শয়তান হচ্ছে তোমাদের উভয়ের প্রকাশ্য দুশমন?। (আল আ’রাফ, আয়াত নং-২২)

শয়তানের প্ররোচনাতেই মানুষ পর্দা খুলে ফেলে এবং তখন নানাবিধ বিপদ ও পাপে পতিত হয়। শয়তান আমাদের প্রকাশ্য শত্র“। এ ব্যাপারে আল্লাহ আমাদের বারবার সাবধান করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন, "হে আদমের সন্তানরা, শয়তান যেভাবে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছে, তেমনি করে তোমাদেরও সে যেন প্রতারিত করতে না পারে, শয়তান তাদের উভয়ের দেহ থেকে তাদের পোশাক খুলে ফেলেছিল, যাতে করে তাদের উভয়ের গোপন ˉ’ানসমূহ উভয়ের কাছে উম্মুক্ত হয়ে পড়ে; মূলত সে নিজে এবং তার সঙ্গী-সাথীরা তোমাদের এমন সব ˉ’ান থেকে দেখতে পায়, যেখান থেকে তোমরা তাদের দেখতে পাও না; যারা (আমাকে) বিশ্বাস করে না তাদের জন্য শয়তানকে  আমি অভিভাবক বানিয়ে দিয়েছি।"(আল আ’রাফ, আয়াত নং-২৭)

অতিশয় বৃদ্ধা মহিলাদের ব্যাপারে পর্দা সংক্রান্ত আল্লাহর ঘোষনা, "যে সকল অতি বৃদ্ধা স্ত্রী লোক, পুনরায় কোন বিবাহের আশা পোষণ করে না, তারা যদি দোপাট্টা খুলে রাখে তাহলে তাতে কোন দোষ নেই। তবে শর্ত এই যে, বেশভূসা প্রদর্শন করা যেন তাদের উদ্দেশ্য না হয়।এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা তাদের জন্য মঙ্গলময়।আর আল্লাহ সবকিছু জানেন ও শুনেন। (আন নূর, আয়াত নং-৬০)

পর্দা হচ্ছে লজ্জার ঢালস্বরূপ, নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেন- "লজ্জা ঈমান, আর ঈমানের বিনিময় জান্নাত।"(তিরমিযী)  "যে ব্যক্তি নিজের জিহ্বা এবং লজ্জাˉ’ান নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, সে সোজা জান্নাতে যাবে।"-(আহমদ, তাবারানী)

নবী করীম (সাঃ) আরো বলেছেন, " আল্লাহ লজ্জাশীলতা ও আবরণ পছন্দ করেন। যে নারী তার স্বামীরগৃহ ব্যতীত অন্যত্র (শরীয়ত বিরুদ্ধ কাজ করার মানসে ) পোশাক খুলে ফেলে, সে আল্লাহ প্রদত্ত ঢালকে ভেঙ্গে ফেললো।"

পর্দা ঈমান বা বিশ্বাসেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। আল্লাহতায়ালা পর্দানশীলদের 'বিশ্বাসিনী নারী' হিসেবে অভিহিত করেছেন।একদা বনু তামীম গোত্রের কিছু মহিলা স্বচ্ছ পোশাকাদি পরে হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি ঐ নারীদেরকে বলেছিলেন, "যদি তোমরা সত্য সত্যই ঈমানদার ও বিশ্বাসী নারী হয়ে থাকো, তবে এগুলো নিশ্চয়ই বিশ্বাসী নারীদের পোশাক নয়। আর তোমরা যদি বিশ্বাসিনী নারী না হয়ে থাকো, তবে এসব উপভোগ করো।"

যাদের সাথে বিয়ে যায়েজ, তাদের সবার সাথেই বিনা প্রয়োজনে ও পর্দা ব্যতীত দেখা-সাক্ষাৎ হারাম।এ প্রসঙ্গে আল-কোরআনের ঘোষণা হলÑ"হে নবী! মুমিন পুরুষদেরকে বলে দিন, তারা যেন নিজেদের চোখকে বাঁচিয়ে চলে এবং নিজেদের লজ্জাˉ’ানসমূহের হেফাজত করে।এটা তাদের জন্য উত্তম। যা তারা করে আল্লাহ সে বিষয়ে পুরোপুরি অবহিত।"(আন নূর, আয়াত নং-৩০)

"আর হে নবী! মুমিন স্ত্রী লোকদের বলে দিন, তারা যেন নিজেদের চোখকে বাঁচিয়ে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাˉ’ানসমূহের হেফাজত করে ও নিজেদের সাজসজ্জা না দেখায়। কেবল সেসব ˉ’ান ছাড়া যা আপনা থেকেই প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং নিজেদের বুকের উপর ওড়নার আঁচল ফেলে রাখে। তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, স্বামীদের পিতা, নিজেদের ছেলে, স্বামীদের ছেলে, তাদের ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনদের ছেলে, নিজেদের স্ত্রী, অধিকারভুক্ত সেবিকা কিংবা এমন শিশু  যারা এখনও মহিলাদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে কিছুই জানে না এমন মানুষ ছাড়া অন্য কারো সামনে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তারা চলার সময় জমিনের ওপর এমনভাবে যেন পা না রাখে যে সৌন্দর্য তারা গোপন করে রেখেছিল তা (পায়ের আওয়াজে) লোকদের কাছে জানাজানি হয়ে যায়। হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর দরবারে তওবা করো, আশা করা যায় তোমরা নাজাত পেয়ে যাবে।"(আন নূর, আয়াত নং-৩১)

আপন গৃহেও নারীর পর্দায় থাকা আবশ্যক। নারী তার গৃহে কাপড় পাল্টাতে পারে, বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারে, কিংবা গরম হতে রক্ষা পেতে, হয়তো একটু গায়ের কাপড় হাল্কা করে বিশ্রাম নিতে পারে। তাই অন্যের ঘরে ঢোকার সময় অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। তা না হলে বেপর্দায় নারী অবাঞ্ছিত অবˉ’ায় পড়তে পারে।এ ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণাÑ"হে ঈমানদারগণ! নিজেদের গৃহ ব্যতীত অনুমতি ছাড়া কারো ঘরে প্রবেশ করো না। যতক্ষণ পর্যন্ত ঘরের লোকদের নিকট থেকে অনুমতি না পাবে এবং যখন ঢুকবে তখন ঘরের অধিবাসীদের সালাম বলবে।এই নিয়ম তোমাদের জন্য কল্যাণকর।আশা করা যায় তোমরা এর প্রতি অবশ্যই খেয়াল রাখবে।"(আন নূর, আয়াত নং-২৭)

"তোমাদের ছেলেরা যখন বুদ্ধির পরিপক্কতা পর্যন্ত পৌঁছাবে, তখন তারা যেন অনুমতি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। যেমন তাদের বড়রা অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢোকে। এভাবেই আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ তোমাদের সামনে উন্মুক্ত করে দেন। তিনি সর্বজ্ঞাত ও প্রজ্ঞাময়।” (আন্ নূর, আয়াত নং-৫৯)

ঘরে-বাইরে সর্বত্রই মেয়েদের মাথা ও শরীর ঢেকে রাখার নিয়ম। মেয়েরা হলো তেতুঁলের ন্যায় যা দেখলে ছেলেদের মুখে পানি আসতে পারে। নারী-পুরুষের অবাধে দেখা-সাক্ষাতে পরস্পরের মাঝে শয়তানী ওয়াসওয়াসার আবির্ভাব ঘটতে পারে। হাদিসে আছে-"মেয়েরা যখন মাথার কাপড় বা ওড়না ফেলে দেয়, সেখানে রহমতের ফেরেশতা থাকে না; শয়তান উপˉি’ত হয়ে তাদের মাঝে বিভিন্ন রকমের ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি করে।"

তাই, ঘরের ভেতর ও বাইরে সর্বদাই নারীদের মাথায় কাপড় বা ওড়না রাখতে হবে, আর ঘর হতে বের হওয়ার সময় পূর্ণ পর্দা রক্ষার তাগিদে বোরকা পরা আবশ্যক।
সন্তানরা যাতে সর্বদা পর্দা রক্ষা করে চলতে পারে এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সতর্ক  দৃষ্টি রাখতে হবে। যেসব অভিভাবক সন্তানদের বেপর্দায় ছেড়ে দেয়, তাদের বলা হয় দাইয়ূস। আর হাদীস শরীফে আছে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন-"দাইয়ূস ব্যক্তি বেহেশতে যাবে না।" সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, দাইয়ূস কে?  নবী করীম (সাঃ) বললেন, "দাইয়ূস  সেই ব্যক্তি যে লক্ষ্য রাখে না যে,তার বাড়ীতে কে এলো, আর কে গেলো ? যে তার স্ত্রী-কন্যাদের বেপর্দাভাবে ঘর হতে বেরুতে দেয়। দাইয়ূসকে ৫০০ বছরের দূরত্ব হতে জাহান্নামে ফেলে দেয়া হবে।"(তিরমিযী)

নারীদের জন্য খোশবু ব্যবহার করে পরপুরুষদের আকর্ষণ করা অত্যন্ত গুনাহের কাজ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন, "যে নারী খোশবু মেখে অন্য পুরুষের মাহফিলের মধ্যদিয়ে চলে যায়, সে নারী  'জেনাকারিণী'।" ( হাকেম, নাসাঈ)।

"কোন নারী যদি খোশবু ও আতর মেখে, যে মাহফিলে গায়রে মাহরাম পুরুষ থাকে সেখানে উপস্থিত হয়, তবে সে নারী জেনাকারিণীর মধ্যে গণ্য হয়।" (আবু দাউদ)।

"যে নারী খোশবু ও আতর মেখে মসজিদে গমন করে যতক্ষণ সে মসজিদ থেকে প্রত্যাবর্তন করে গোসল না করে ততক্ষণ পর্যন্ত তার নামায কবুল হয় না।" (ইবনে খোযায়মা)।

উম্মে খালাদ নামক এক মহিলার সন্তান জিহাদে শহীদ হলে বোরকা পরিধান করে তিনি নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে ছেলের অবˉ’া জানতে আসলেন। তখন একজন সাহাবী বললেন, কি আশ্চর্য! মেয়ে লোকটি বোরকা পরে নিজের ছেলের অবˉ’া জানতে এসেছে? (অর্থাৎ) এটা তো বোরকা পরার সময় নয়। বরং বিলাপ এবং ক্রন্দন করার সময়। তখন মেয়ে লোকটি উত্তর করলেন,"আমার ছেলে মরেছে সত্য কিন্তু আমার লজ্জা শরমতো মরে নাই।" (আবু দাউদ)

ঠিক তাই, যাদের লজ্জা শরম আছে, তারা কখনও পর্দাহীন হয়ে নির্লজ্জ বেহায়ার মতো চলতে পারে না।এমনকি স্বামী-সন্তান হারাবার মতো কঠিন মুহূর্তেও তারা বেপর্দা হয় না। এটাই পর্দাশীলা নারীদের ঈমানের সফলতা।

বেপর্দায় চললে ইহজগতেও নানাবিধ অঘটনের সম্মুখীন হতে হয়। আর পরকালের শাস্তিতো আছেই। হাদীছে আছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- "দোযখীদের দুটি প্রকার আমি দেখে যেতে পারিনি, তন্মধ্যের একজন হচ্ছে- সে সব নারী, যারা পোশাক পরেও উলঙ্গ এবং যারা গর্বিত ভঙ্গিমায় কাঁধ হেলিয়ে দুলিয়ে অপূর্ব চালে চলবে। তাদের মস্তক উটের পিঠের মতো হবে। অর্থাৎ মাথায় কৃত্রিম কেশ সংযোজনের ফলে খোঁপা উঁচু হবে।তারা জান্নাতে যাবে না।বরং জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের ঘ্রাণ অনেক দূর থেকে পাওয়া যায়।" (মুসলিম শরীফ)

পাতলা ও ফিনফিনে কাপড় পরিধান করাও পর্দার বহির্ভূত কাজ।এরাও অভিসম্পাতের যোগ্য।এ প্রসঙ্গে হাদীসে আছে, নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন- "যেসব স্ত্রীলোক এমন পাতলা কাপড় পরিধান করে, যার মধ্য দিয়ে তাদের অংগ দৃষ্ট হয়, সেসব স্ত্রী লোক বিলাস-ব্যাসন দ্বারা নিজেদের প্রতি পরপুরুষদেরকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে এবং নিজেরাও পরপুরুষদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এতে স্পষ্টই প্রতিয়মান হয় যে, যদিও বাইরে তারা কাপড় পরিধান করে থাকে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা উলঙ্গ। এসব  স্ত্রীলোক অভিসম্পাতের যোগ্য তোমরা এদের প্রতি অভিশাপ দাও।এরা প্রকৃতই মালাউন। অভিশপ্ত।" (হাকেম)

নারী কতৃক পুরুষের পোশাক পরিধান ও পুরুষের রুপ ধারণ ইসলামে পর্দার পরিপন্থি। এদের জন্যে রয়েছে আল্লাহর অভিসম্পাত ও গজব। হাদীসে আছে,
নবী করীম (সাঃ) বলেছেন-"মেয়েদের নমুনা ধারণকারী পুরুষের উপর এবং পুরুষের নমুনা ধারণকারী মেয়েদের উপর অভিসম্পাত।" (বোখারী)

"সেসব লোকের উপর অভিসম্পাত পতিত হোক যারা মেয়ে লোকদের অনুকরনে বেশভূষা ধারণ করে চলাফেরা করে, যেসব মেয়েলোক পুরুষের অনুকরনে বেশভূষা ধারণ করে চলাফেরা করে, তাদের উপরেও আল্লাহর গজব পতিত হোক।"-(বোখারী, সুনান)

হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, নারীদের এমন আঁটসাট কাপড় পরতে দিওনা যাতে শরীরের গঠন পরিস্ফুটিত হয়ে পড়ে।
দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণে রাখাও পর্দার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রত্যেকেরই দৃষ্টি সংযত করে রাখা উচিত। নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন-"দৃষ্টি ইবলিসের বিষাক্ত তীরসমূহের একটি। যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলার ভয়ে তা থেকে বেঁচে থাকে, আল্লাহতা’য়ালা তাকে ঈমানের এমন নূর দান করেন, যার স্বাদ সে স্বীয় অন্তরে অনুভব করে।"

যে পুরুষ কিংবা স্ত্রী, একে অন্যের প্রতি ইচ্ছাকৃত কুদৃষ্টি করে, শেষ বিচারের দিন তাদের চক্ষুতে গরম সীসা ঢেলে প্রতিশোধ নেয়া হবে। যারা নিজেদের দৃষ্টি এবং লজ্জাˉ’ানের হেফাযত করে না আল্লাহতা’য়ালা তাদের চেহারা পরিবর্তন করে দেন।

হাদীসে আছে, নবী করীম (সাঃ) আলী (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বললেন, "হে আলী! কোন মেয়েলোকের উপর যদি হঠাৎ তোমার দৃষ্টি পড়ে যায়, তবে ইচ্ছাকৃতভাবে দ্বিতীয়বার দৃষ্টিপাত করো না। কেননা, প্রথমবারের দৃষ্টি ক্ষমার যোগ্য কিন্তু দ্বিতীয়বারের ইচ্ছাকৃত দৃষ্টির জন্য জবাবদিহি করতে হবে।" (তিরমিযী)

যে নারী স্বামী ছাড়া অন্যকে দেখানোর জন্য সাজসজ্জা করে ও সৌন্দর্য প্রদর্শন করে তাকে বলে ’তাবাররুজুল জাহিলিয়াত’। যদি কেউ এই উদ্দেশ্যে আকর্ষণীয়, সুন্দর ও উজ্জল রঙের বোরকা পড়ে তাও ’তাবাররুজুল জাহিলিয়াত’ হিসেবে গণ্য হবে। অবশ্য সব কিছুই নিয়ত ও ঈমানের উপর নির্ভর করে। নারী স্বয়ং জানে তার বিবেক কিসে তাড়িত হয়।

স্বামী-স্ত্রীর গোপন কথা অপরের কাছে প্রকাশ করা নিষিদ্ধ।এতে মুখের পর্দা বিনষ্ট হয়।এ প্রসঙ্গে হাদীসে আছে,"নারী-পুরুষকে নিষেধ করা হয়েছে যে, তারা যেন তাদের দাম্পত্য সম্পর্কিত গোপন অবˉ’ান অপরের নিকট বর্ননা না করে, কারণ এতেও অশ্লীলতার প্রচার হয় এবং মনের মধ্যে প্রেমাসক্তির সঞ্চার হয়।" ( আবু দাউদ)

আলী (রাঃ) বলেছেন, "দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বিস্ময় এই যে, মানুষ প্রতিদিন তার সামনে অসংখ মানুষকে মরতে দেখেও মৃত্যুর কথা স্মরণ করে না।"

বেপর্দার কারনেই আজ ঘরে ঘরে অশান্তি বিশৃঙ্খলা আর চলছে ঘর ভাঙ্গার খেলা। নারী-পুরুষের জীবন যে আজ কত দুর্বিসহ, বিপর্যস্ত, বেসামাল ও দুর্গতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে তা দেখেও যদি আমরা পর্দার গুরুত্ব অনুধাবন করতে না পারি তবে ইহ্কালে সীমাহীন দুর্গতিতো আছেই আর পরকালেও অনন্তকাল জ্বলতে হবে দোষখের আগুনে।

বেপর্দায় চলে একজন সিনেমার নায়িকা একাই পারে লক্ষ-কোটি পুরুষের চোখকে খারাপ করে দিতে। বেপর্দার ফলাফল অত্যন্ত ভয়াবহ।মৃত্যুর পর মহিলাদেরকে পর্দার জন্য কঠিন বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। হাদীসে আছে, "দোষখীদের অধিকাংশই হবে নারী।" তাই সব নারীদেরই উচিত পূর্ণ পর্দা রক্ষা করে চলা।

মূর্খ, বোকা ও অবলা নারীরা হয়তো ভাবতে পারে তাদের উপর জোর করে পর্দার বিধান চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।আসলে তা নয়। পর্দা নারীর মৌলিক অধিকার। পর্দার সাথে চলতে পারাটাই নারীর ন্যায্য পাওনা। মেয়েরা হীরার চেয়েও বেশী মূল্যবান। তাইতো সাত পর্দার মাঝে লুকিয়ে রাখার নিয়ম এই অতিমূল্যবান সতী নারীদের। আসুন মা ও বোনেরা, আর দেরী নয়। আমাদের মূল্য আর আমরা না কমাই। আজ থেকে এই মূহূর্ত থেকে থাকি আমরা পূর্ণ পর্দায়। আল্লাহ আমাদের সহায় হোক। আমীন।

প্রকাশ: দৈনিক ইনকিলাব (ইসলামী জীবন), ১২ এপ্রিল, ১৪ এপ্রিল, ১৯ এপ্রিল, ২১ এপ্রিল, ২০০৯।


১১. সন্তান প্রতিপালনে মায়ের ভূমিকা

 
By: Khandaker Nazneen Sultana

"নবী  করীম (সাঃ) বলেছেন,  তোমাদের সন্তানদেরকে জ্ঞানদান করো, কেননা তারা তোমাদের পরবর্তী যুগের জন্য সৃষ্ট।" আর সর্বাগ্রে মা’ই পারে এ দায়িত্ব পালন করে সন্তানকে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে। কারণ, মা’ই সন্তানের সবচেয়ে কাছের। সন্তানের সাথে মায়ের নাড়ীর সম্পর্ক। মায়ের কোলে বসে ও মায়ের সান্নিধ্যে অতি অল্প সময়ে সন্তান যা শিখতে পারে মায়ের সান্নিধ্যের বাইরে তা আয়ত্ত্ব করা সন্তানের জন্য দীর্ঘদিনেও অনেকক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠে না।

সন্তান যখন মায়ের গর্ভে থাকে, তখন থেকেই মায়ের চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতা, কাজকর্ম ও আচার-আচরনের  ছাপ সন্তানের উপর ˉ’ায়ী প্রভাব ফেলতে থাকে এবং ক্রমেই তা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। তাইতো আদর্শ মায়ের সন্তান হতে পারে সচ্চরিত্রবান, কর্মঠ, বিচক্ষণ, উন্নত মেধা ও মননসম্পন্ন।

মায়ের চরিত্রই সন্তানের চরিত্রে সবচেয়ে বেশী প্রতিফলিত হয়। আদর্শ ও চরিত্রবান মায়ের সন্তানও আদর্শ ও চরিত্রবানই হয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যত জ্ঞানী-গুণী ও বিশেষ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তির এই পৃথিবীতে আগমন ঘটেছে তাদের সকলের মা’ই আদর্শ মা ছিলেন।যেমন-হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর মা খাদিজা (রাঃ), বায়েজিদ বুস্তামের মা, হযরত ঈসা (আঃ)-এর মা মারিয়াম (রাঃ)।

সন্তানদের কিভাবে মহান ব্যক্তিত্বশীল ও অনুকরনীয় আদর্শরুপে গড়ে তোলা যায়, সে ব্যাপারে আল কোরআনের সূরা লোকমানে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে-
*শৈশব থেকেই সন্তানদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে শিক্ষা দান করতে হবে।
*শিরক ও বিদ’আতের ধারণা দিতে হবে।
*বিনয়ী, ভদ্র ও নম্র হতে শেখাতে হবে।
*ভালো কাজের আদেশ ও মন্দকাজে বাধাদানে অনুপ্রাণিত করতে হবে।
*ধৈর্য ও সহনশীলতার শিক্ষাদান প্রয়োজন।
*বোঝাতে হবে পরনিন্দা, মিথ্যা ও অহংকার মারাত্মক অপরাধ।
*নিয়মিত নামাজ পড়া, দান-খয়রাত করা, শালীনতা বজায় রেখে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করা অবশ্যই পালনীয়।
সন্তানদের এসব জানানো, বোঝানো ও পালন করানো আবশ্যক। সন্তানদের এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণে মা’ই পারে মুখ্য ও অগ্রনী ভূমিকা রাখতে।

একটি মুরগী যেমন তার পাখা দিয়ে বাচ্চাদেরকে শত্র“র আক্রমণ হতে রক্ষা করতে পারে, তেমনিভাবে একজন মা’ও স্নেহ-মায়া-মমতা ও শাসনের ছায়ায় রেখে সন্তানদের সমস্ত কুপ্রভাবও খারাপ কাজ থেকে আগলে রাখতে পারে।

প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি শিশুই যদি আদর্শরুপে বেড়ে উঠতে পারে, তবে খুব সহজেই তেরী হয়ে যাবে আদর্শ ও চরিত্রবান সমাজ, দেশ ও বিশ্ব।
নেপোলিয়ন তাইতো বলেছেন- "আমায় একটি আদর্শ মা দাও, আমি তোমায় একটি আদশ জাতি দেবো।"

মা’ই ঘরের আকর্ষণ, মা’ই ঘরের মূল্যবান সম্পদ। যে গৃহে মা নেই সে গৃহের কোন আকর্ষণও নেই।

এ বিশ্ব ভূমন্ডলে মানুষের সর্বাধিক কাছের মানুষই তার মা। মা’ই সন্তানের জন্য সবচেয়ে বেশী কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেন। আর তাইতো 'মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেশত।' মায়ের এই মূল্যবান মর্যাদার কারণ মা দশ মাস দশ দিন অনেক কষ্ট ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন।তারপর অবর্ণনীয় প্রসব বেদনা, সন্তানকে দুই বছর পর্যন্ত দুধ খাওয়ানো, এসব মায়েরই দায়িত্ব।

সংসার সাজাতে ও সন্তান প্রতিপালনে মায়ের গুরুত্ব ও ভূমিকা অপরিসীম।তাই আসুন- আমি, আপনি এবং আমরা সকলেই অনুকরনীয় আদর্শ মা হয়ে গড়ে উঠি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সকল ভাল কাজ করার তৈফিক দান করুন।আমিন।

প্রকাশ: দৈনিক ইনকিলাব (ইসলামী জীবন), ৯ আগস্ট ২০০৯।


১২. মাহে রমজানের মাহাত্ম
Written by: Khandaker Nazneen Sultana


পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “হে ঈমানদারগন! তোমাদের উপর রোযা ফরজ করা হয়েছে যেরুপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারে।”(সূরা বাকারা আয়াত নং ১৮৩)

অর্থাৎ প্রত্যেক সাবালক ও সুস্থ মুসলিম নর-নারীর জন্য পবিত্র রমজান মাসে সিয়াম পালন করা ফরজ। রোজা বা সিয়াম পালন শুধু উপবাসের নামান্তর নয়। বরং এর অন্তনিহিত অর্থ আরো অনেক গভীর, ব্যাপক, সূদূর প্রসারী ও মাহাতœ্যপূর্ন। রোজার অর্থ আত্মসংযম ও তাকওয়া অর্জন।

হুযুর পাক (সাঃ) এরশাদ করেছেন, “রোজা ধৈর্যের অর্ধেক।” অপর হাদীসে আছে, ‘ধৈর্য ঈমানের অর্ধেক।’ রোজা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয়। কারন রোজার মাধ্যমেই বান্দার ধৈর্য ও ঈমানের প্রকৃত পরীক্ষা হয়ে যায়।

রোজাদার তার ভোগলিপ্সা এবং পানাহার শুধু আল্লাহর জন্যই বর্জন করে। তাই আল্লাহ নিজেই এর প্রতিদান দেবেন। এ প্রসঙ্গে একটি হাদীস উল্লেখ করা যায়, ‘হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন, "আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব দশগুন হতে সাতশত গুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।" কিন্তু আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন রোজা এই সাধারন নিয়মের ব্যতিক্রম। কেননা উহা একান্ত ভাবে আমারই জন্য। অতএব আমিই (যেভাবে ইচ্ছা) উহার প্রতিফল দিব।

রোজা পালনে আমার বান্দা আমারই সন্তোষ বিধানের জন্য স্বীয় ইচ্ছা বাসনা ও পানাহার পরিত্যাগ করে থাকে।রোজাদারের জন্য অনন্দ দুটি। একটি ইফতারের সময় এবং অন্যটি তার মালিক বা মনিব আল্লাহর সাথে সাক্ষাত লাভের সময়। কসম সেই প্রতিপালকের যার করতলে আমার প্রাণ, নিশ্চই রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মেশক (কস্তুরী বা মৃগনাভী) থেকেও উত্তম। --- (বুখারী, মুসলিম)

রোজার মাঝে বিশেষত্ব এই যে, অন্যান্য এবাদত লোকে দেখতে পায়। কিন্তু রোজা এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ দেখতে পায় না। রোজা দ্বারাই আল্লাহর প্রতি আন্তরিক ভক্তি ও ভয়ের পরিচয় পাওয়া যায়। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ পাক ফরমান, ‘বান্দা রোজা রেখে তার আহার ত্যাগ করে আমার জন্য, পানীয় ত্যাগ করে আমার জন্য এবং স্ত্রী ব্যবহার ছেড়ে দেয় আমার জন্য।’

রোজার দ্বারাই আল্লাহর সাথে বান্দার গভীর মহব্বতের সৃষ্টি হয়। তাই হাদীসে রোযাকে সমস্ত আমলের মধ্যে অতুলনীয় এবং অনুপম আমল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্নিত, তিনি বললেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর খেদমতে আরজ করলাম, হুযূর! আমাকে খুব মূল্যবান একটি আমলের হুকুম দিন! হুযুর (সাঃ) বললেন, তুমি রোজা রাখ। কারণ রোজার ন্যায় আমল আর নাই। অর্থাৎ রোয়ার দ্বারা যে বিশেষত্ব তৈরী হয়, তা অন্য কোন আমলের মাঝে পাওয়া যায় না। রোযার কঠোর সাধনায় মানুষ খুব সহজেই পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। এই অর্থেই হাদীসে রোজাকে দোযখের আযাব হতে রক্ষা পাবার ঢাল বা কেল্লা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
“রোযা দোযখের আযাব হতে রক্ষা করার জন্য একটি অতি শক্ত ঢাল এবং একটি অতি দৃঢ় প্রাচীর।” (বায়হাকী)

আবার হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, হাদীসে পাই, তিনি বলেন, “তোমাদের কেউ কোনদিন রোজা রাখলে তার মুখ থেকে যেন খারাপ কথা বের না হয়। কেউ যদি তাকে গালমন্দ করে বা বিবাদে প্ররোচিত করতে চায়, সে যেন বলে আমি রোজাদার।”  (বুখারী, মুসলিম)

অর্থাৎ শুধু উপবাস থাকলেই রোজা হবে না। রোজাদারের দেহ-মন-আত্মা সব একসাথে সংযম সাধনায় অভ্যস্ত হতে হবে। তাইতো পবিত্র এক হাদীসে উল্লেখ আছে, “এমন অনেক সিয়ামকারী রয়েছে, যাদের কেবল ক্ষুধা আর পিপাসা ছাড়া তাদের ভাগ্যে আর অন্য কিছুই জোটেনা। তেমনি রাত্রিতে ইবাদতকারী অনেক মানুষ এমন আছে, যারা কেবলমাত্র রাত্রি জাগরন ব্যতীত আর কিছুই লাভ করতে পারে না।”

এ প্রসঙ্গে আর একটি হাদীসে আছে, “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও অন্যায় কাজ পরিত্যাগ করবে না, কেবল মাত্র তার খানাপিনা পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।” (বুখারী, তিরমিযী, আবু দাউদ শরীফ)

পবিত্র কোরআনে সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে আছে, ''রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্য পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোজা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে গননা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না।"
অর্থাৎ আল্লাহ তা’লা এ মাসটিতেই স্বীয় ওহী এবং আসমানী কিতাব নাযিল করেন। কোরআনও প্রথম এ মাসেই অবতীর্ন হয়েছে।

মুসনাদে আহমদ গ্রন্থে হযরত ওয়াসেলা ইবনে আসকা থেকে রেওয়ায়েত করা হয়েছে যে, রাসূল করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর সহীফা রমযান মাসের ১ তারিখ নাযিল হয়েছিল। আর রমযানের ৬ তারিখ তওরাত, ১৩ তারিখে ইঞ্জিল এবং ২৪ তারিখে কোরআন নাযিল হয়েছে।’

হযরত জাবের (রাঃ) এর রেওয়ায়েতে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘যবুর’ রমযানের ১২ তারিখে এবং ইঞ্জিল ১৮ তারিখে নাযিল হয়েছে।’   (ইবনে-কাসীর)

আল কোরআন সর্বপ্রথমে রমযানের কোন এক তারিখেই লওহে মাহফুয থেকে পৃথিবীর আকাশে নাযিল করা হয়। তারপর নবী করীম (সাঃ) এর উপর ধীরে ধীরে তেইশ বছরে তা অবতীর্ন হয়। (মা আরেফুল কোরআন)

রমযানের রোযাসমূহের গুরুত্ব এতই বেশী যে, কোন অবস্থাতেই এই রোযাগুলো বাদ দেয়া যাবে না। অসুস্থতা বা শরীয়ত সম্মত কোন বিশেষ কারনে রমযান মাসে কোন রোজা ভাঙ্গা গেলেও পরে এগুলো পূরন করে নিতে হবে। রমযানের গুরুত্ব অপরিসীম। এর প্রমান স্বরুপ কতিপয় হাদীসে উল্লেখ করা যায়।

আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, "হযরত নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের নিকট রমযান মাস সমুপস্থিত। উহা এক অত্যন্ত বরকতময় মাস। আল্লাহ তা’য়ালা এ মাসে তোমাদের প্রতি রোযা ফরজ করেছেন। এ মাসে আকাশের দরজাসমূহ উম্মুক্ত হয়ে যায়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং এ মাসে বড় বড় ও সেরা শয়তান গুলো আটক করে রাখা হয়। আল্লাহর জন্য এ মাসে একটি রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়েও অনেক উত্তম। যে লোক এই রাত্রির মহা কল্যান লাভ হতে বঞ্চিত থাকলো, সে সত্যই বঞ্চিত ব্যক্তি।"  (নাসায়ী, মুসনাদে আহমদ, বায়হাকী)

হযরত আবু হোরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত ‘হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ঘোষনা করেছেন, যে লোক রমযান মাসের রোযা রাখবে ঈমান ও চেতনা সহকারে, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)

‘হযরত নবী করীম (সাঃ) ফরমান যে, "প্রত্যেক জিনিসেরই যাকাত আছে। শরীরের যাকাত হচ্ছে রোযা, কেননা রোযা দ্বারা শরীরের পবিত্রতা সাধিত হয়।"
অর্থাৎ যাকাত দ্বারা যেরুপ টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদের ময়লা দূর হয়, সেরুপ শরীরের মাঝে সব দুষিত পদার্থ জমাট বেঁধে জম্মানো রোগ দূরীভূত হয় রোজার মাধ্যমেই।

রোজার পুরস্কার শুধু এই পৃথিবীতেই নয়, পরকালেও রোযাদারদের জন্য রয়েছে অত্যন্ত আকর্ষনীয় ও সম্মানজনক উপহার। হাদীসে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘রোযাদার ব্যক্তি যখন ইহজীবন শেষ করে আখেরাতে আল্লাহতা’য়ালার সাক্ষাত লাভ করবে, তখন তার আর খুশীর সীমা থাকবে না। (বুখারী)

হযরত সহল ইবনে সাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসে পাই, হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন, "বেহেশতের একটি দুয়ার আছে উহাকে রাইয়্যান বলা হয়। এই দ্বার দিয়ে কিয়ামতের দিন একমাত্র রোযাদার লোকেরাই বেহেশতে প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া অন্য কেউ এই পথে প্রবেশ করবে না। সেদিন এই বলে ডাক দেয়া হবে, রোজাদার কোথায়? তারা যেন এই পথে প্রবেশ করে, এভাবে সকল রোযাদার ভিতরে প্রবেশ করার পর দ্বারটি বন্ধ করে দেয়া হবে। অতঃপর এ পথে আর কেউ প্রবেশ করবে না।"  (বুখারী, মুসলিম)

হযরত আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত এক হাদীসে পাই, "রাসূল করীম (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, যে লোক একদিন আল্লাহর পথে রোযা রাখবে, আল্লাহ তার মুখমন্ডল জাহান্নাম হতে সত্তর বৎসর দূরে সরিয়ে রাখবেন।"  (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাযায়ী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত এক হাদীসে পাই, "রাসূল (সাঃ) বলেছেন, রোযা ও কোরআন রোযাদার বান্দার জন্য শাফায়াত করবে, রোযা বলবে, হে আল্লাহ আমি এ ব্যক্তিকে দিনে খাবার ও অন্যান্য কামনা বাসনা থেকে ফিরিয়ে রেখেছি। আপনি আমার সুপারিশ গ্রহন করুন। কোরআন বলবে, হে আল্লাহ আমি এ ব্যক্তিকে রাতের নিদ্র্া থেকে ফিরিয়ে রেখেছি। আপনি আমার সুপারিশ গ্রহন করুন, আল্লাহ তাদের সুপারিশ গ্রহন করবেন।" (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান)

রোজা আল্লাহর প্রতিপক্ষের উপর ভীষন চাপের সৃষ্টি করে। কেননা কামনা-বাসনা হলো আল্লাহর প্রতিপক্ষ শয়তানের হাতিয়ার সদৃশ। রোজার মাধ্যমে সে কামনা ও বাসনাকে ধ্বংস করে শয়তানকে প্রতিহত করা যায়।

মুহাম্মদ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, "শয়তান মানুষের ধমনীতে চলাচল করে, তোমরা ক্ষুধা তৃষ্ণার মাধ্যমে সে ধমনীকে সংকীর্ন করে দাও।" তিনি হযরত আয়েশা (রাঃ) কে বলেছেন সর্বদা বেহেশতের দরজায় কড়া নাড়তে থাক। তাঁকে জিজ্ঞেসা করা হলো, তা কিভাবে ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ), তিনি বললেন- ’ক্ষুধার দ্বারা।’

পুরো রমজান মাসে সমগ্র বেহেশত জুড়ে চলতে থাকে উৎসবের আমেজ। দোষখীদের জন্যও এটি একটি শান্তির মাস। এ প্রসঙ্গে একটি হাদীস উল্লেখ করা যায়।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, "রাসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন, যখন রমযান শরীফের প্রথম রাত হয় এবং পুরো মাস এসব দরজা খোলা থাকে, দোষখের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়, আর সমস্ত মাস দোযখের দরজাসমূহ বন্ধ থাকে। এসময়ের মধ্যে দোযখের কোন একটি দরজাও খোলা হয় না এবং বিদ্রোহী জ্বিনসমূহকে বন্দী করা হয়।"

আর রমযান মাসের প্রত্যেক রাতে এক আওয়াজদাতা সোবহ সাদেক পর্যন্ত সারা রাত এই আওয়াজ দিতে থাকে যে, ’হে কল্যান ও নেকীর অন্বেষনকারী, নেকীর সংকল্প কর এবং খুশী হয়ে যাও। আর হে বদ কাজের সংকল্পকারী! বদ কাজ হতে ফিরে যাও এবং নিজের অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা কর এবং সেসবের পর্যালোচনা কর।’
আওয়াযদাতা এই আওয়ায দেয়, ’আছে কি গোনাহের ক্ষমা প্রার্থনাকারী কেউ? তার গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আছে কি কেউ তওবাকারী ? তার তওবা কবুল করা হবে। কোন দোয়াকারী আছে কি ? তার দোয়া কবুল করা হবে। কেউ কি কোন বস্তু সম্পর্কে প্রার্থনাকারী আছে? তার প্রার্থনা পূর্ণ করে দেয়া হবে।’

রমযান মাসে প্রত্যেক রাতে ইফতারের সময় প্রায় ষাট হাজার ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে। যখন ঈদুল ফেতরের দিন আসে তখন আল্লাহ তা’আলা বিপুল সংখক ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। রমযানের প্রত্যেক রাতে ছয় লাখ এবং শেষ রাতে এক কোটি আশি লাখ ব্যক্তিকে ক্ষমা করা হয়। অর্থাৎ শুধু ঈদুল ফিতরের দিনই প্রায় আঠারো লাখ লোক জাহান্নাম হতে নাজাত লাভ করে। 
(আততারগীব ওয়াততারহীব)

রমযান হলো আল্লাহর তরফ হতে বান্দাকে পুরস্কার বিতরনীর মাস। এ মাসে উম্মতের জন্য পাঁচটি বিশেষ পুরস্কার রয়েছে। এ সম্পর্কিত হাদীসটি হলো, হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন, আমার উম্মতকে রমযান শরীফ সম্পর্কিত পাঁচটি বিশেষ বস্তু দেয়া হয়েছে, যা পূর্ববর্তী উম্মতসমূহ পায়নি।
(১) রোজাদারদেরের মুখের গন্ধ (যা ক্ষুধার কারণে সৃষ্টি হয়, আল্লাহ তা’আলার কাছে তা মেশকের চেয়েও বেশী পছন্দনীয়।
(২) তাদের জন্য সমুদ্রের মৎসগুলিও ইফতার পর্যন্ত দোয়া করতে থাকে।
(৩) তাদের জন্য প্রত্যহ জান্নাতকে সাজানো হয়, অতঃপর আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, সে সময়ে নিকটে যে, আমার বান্দা (দুনিয়ায়) দুঃখ-কষ্ট নিজের উপর থেকে ফেলে দিয়ে তোমার দিকে আসবে।
(৪) এ মাসে দুষ্ট শয়তানগুলিকে বন্দী করা হয়।
(৫) রমযানের শেষ রাতে রোযাদারদের ক্ষমা করা হয়।  (আততারগীব ওয়াততারহীব)

রমযান মাসের সর্ববৃহৎ ফযীলত হচ্ছে- (১) এ মাসে এমন একটি রাত আছে যা হাজার মাসের-চেয়েও উত্তম।রমযান মাসে প্রত্যেক এবাদতের সওয়াব বৃদ্ধি করা হয়। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন- "এ মাসে যে ব্যক্তি কোন প্রকার নফল এবাদত করবে, তার সওয়াব রমযানের বহির্ভূত সময়ের ফরজের সমান লাভ করবে।"

রমযান মাস ছবর, সহযোগীতা সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মাস। এ মাসে ঈমানদারদের রিযিক বৃদ্ধি করা হয়।
রোযার বরকত ও ফযীলত অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে কিছু হাদীস উল্লেখ করা যেতে পারে।
হযরত আবু মালেক আশআরী (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন- "রোযাদারকে জান্নাতে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন বালাখানা দান করা হবে। যেগুলোর বাইরে থেকে অভ্যন্তর এবং অভ্যন্তর থেকে বাইরে দৃষ্টিগোচর হবে।"  (ইবনে হিরান)

রাসুল করীম (সাঃ) বলেছেন, জিহাদ কর, আল্লাহ তা’আলা গণীমত দান করবেন। রোযা রাখ, সুস্থ থাকবে। সফর কর, সম্পদশালী হবে।  (তাবারানী)

নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য দিনে রোযা রেখেছে, তবে আল্লাহ তা’আলা তাকে কাকের সমগ্র জীবনব্যাপী উড়তে থাকার দূরত্ব পরিমাণ জাহান্নাম থেকে দূর করে দেবেন।  (বায়হাকী, আবু ইয়ালা)

রমযান মাসে শয়তানগুলো বন্দী থাকায় রোযাদারকে গোনাহের প্রতি তেমন উদ্দীপিত করতে পারে না। তাই প্রত্যেক ব্যক্তিই রমযান মাসে গুনাহ কম করে তারপরেও মানুষের নফস অনেক সময় মানুষকে গোনাহের পথে পরিচালিত করে। সিয়াম সাধনায় রমযান মাসে নফসগুলো তুলনামূলক শান্ত থাকে। রোযাই হল শয়তানকে জব্দ করার প্রথম হাতিয়ার।

হুযুরে পাক (সাঃ) এরশাদ করেছেন- "মানুষের অন্তরে যদি শয়তানের আনাগোনা না থাকত, তাহলে মানুষ উর্ধ্ব দেখার দৃষ্টি সম্পন্ন হয়ে যেত।" এজন্যই রোযাকে অন্যান্য ইবাদাত সমূহের দরজা এবং ঢাল বলা যায়।

নবী করীম (সাঃ) বলেছেন- "রোযা একটি আমানত সদৃশ। আমাদের সবারই এ আমানত হেফাজত করা উচিৎ।"  (এহইয়াউ উলূমিদ্দীন)

হাদীসে আছে- "বহু রোযাদারের রোযাই শুধু ক্ষুধা-তৃষ্ণার ক্লেশ বরণ ছাড়া আর কিছু নয়।" আমাদের রোজা যেন তেমনটি না হয়। একজন বিজ্ঞ আলিম বলেছেন যে, ‘অনেক রোযাদারই রোযাদার নয় এবং অনেক বেরোযদার ব্যক্তিও রোযাদার।’ অর্থাৎ রোযা রেখে নিজ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও নফসকে গুনাহ ও পাপকার্য থেকে বিরত না রাখলে সে রোযা মূল্যহীন। তা রোযা হবে না, শুধুমাত্র পানাহার বর্জন হবে। আর বেরোযদার হয়েও রোযাদার সে সমস্ত লোক, যারা নিজ অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে গুনাহ ও পাপকার্য হতে বিরত রাখে। রোযার অর্থ- আল্লাহর বিশেষ গুন, ক্ষুধা ও পিপাসা থেকে মুক্ত হওয়াকে নিজেদের অভ্যাসে পরিণত করে নেয়া। সকল মন্দ ও কুপ্রবৃত্তিকে ধ্বংস করা।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন- "কোন ব্যক্তি আল্লাহর জন্য একদিন রোযা রাখলে আল্লাহ তা’আলা জাহান্নামকে তার থেকে সত্তর বছরের রাস্তা দূর করে দেন।" (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসাই)

আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন- "আমার বান্দাগন এতকষ্ট স্বীকার করে আমার জন্যই রোযা রেখে থাকে। অতএব রোযার পুরষ্কার দিতে আমি নিজেই তাদের সম্মুখে উপস্থিত থাকবো। (এবং আমার ইচ্ছানুযায়ী তাদেরকে সন্তুষ্ট করিব।)"

হযরত নবী করীম (সাঃ) ফরমাইয়াছেন-“যারা রমযান মাসের প্রথম তারিখ হতে শেষ তারিখ পর্যন্ত রোযা রেখেছে তারা ঐ দিনের মত নিস্পাপ হয়ে যাবে, যেদিন তাদের মা তাদেরকে নিস্পাপরুপে প্রসব করেছেন।”

হাদীস শরীফে আছে- "কিয়ামতের দিন অন্যান্য লোক যখন হিসাব নিকাশের কঠোরতায় আবদ্ধ থাকবে, তখন রোজাদারের জন্য আরশের ছায়ায় দস্তরখানা বিছানো হবে, এবং তারা সানন্দে পানাহার করতে থাকবে, তখন অন্যান্য লোক আশ্চর্যান্ধিত হয়ে বলবে, একি ব্যাপার! তারা সানন্দে পানাহার করছে, আর আমরা এখন হিসাবের দ্বারে আবদ্ধ আছি ? উত্তরে বলা হবে, পৃথিবীতে তোমরা যখন সানন্দে পানাহার করেছিলে তখন তারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে রোযা রেখে ক্ষুৎ-পিপাসার যন্ত্রনা সহ্য করেছিল। তোমরা যখন সানন্দে নিদ্রা যেতে, তখন তারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে রাত্রি জাগরন থেকে তাহাজ্জুদ ও তারাবীহ-এর নামায পড়েছিল।"

নবী করীম (সাঃ) আরো বলেছেন- "রমযান এমন একটি মাস, যার প্রথমাংশে আল্লাহর রহমত বর্ধিত হয়, মধ্যমাংশ ক্ষমা বিতরন ও শেষাংশে দোজখের বন্দীদিগকে মুক্তি দেয়া হয়।"
এ মাসে যে ব্যক্তি তার ভৃর্ত ও পরিচালকের শ্রম লাঘব করবে, আল্লাহতা’আলা তার পাপ সমূহ মার্জনা করবেন ও দোযখের আযাব রহিত করবেন।

শুধু পরকালে নয়, এই পৃথিবীতেও রোজার অনেক উপকারিতা রয়েছে। রোজায় শরীর হালকা হয়, স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। মানুষের শরীর একটি বিশেষ যন্ত্র। এর বহু কল-কব্জা রয়েছে। ধাতু নির্মিত নির্জীব যন্ত্রেরও বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। বিশ্রামের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। শরীরের পক্ষেও একথা অনস্বীকার্য। রোজাই শরীরের যন্ত্রাদির বিশ্রামের উত্তম ব্যবস্থা করে। রিপু মানুষের পরম শত্র“। ভোগে রিপু প্রবল হয়। আর রোযার মাধ্যমে রিপু দমিত থাকে ও সংযত হয়।

রোজায় মন উন্নত হয়। মনের একাগ্রতা সহজ হয়। অলস ভাব দূর হয়। চিন্তন শক্তি বৃদ্ধি পায়। সর্বোপরি রোজায় আত্মার কল্যান সাধন হয়। সত্ত্বা কষ্ট-সহিষ্ণুতায় অভ্যস্ত হয়। দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতি জন্মে।

দেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রত্যেকেরই ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সততা, শালীনতা, কর্তব্য পরায়নতা, ইনসাফ ও মনুষত্ব জাগ্রত হওয়া আবশ্যক। বরকতের মাস মাহে রমজানে রোযার মাধ্যমে এই সব গুনাবলী অর্জনে আমাদের সকলকেই ব্রতী হতে হবে।

আল্লাহ আমাদেরকে রমযানের মাহাত্ম ও গুরুত্ব অনুধাবন এবং প্রকৃত রোযাদার হয়ে ইহকালীন ও পরকালীন সকল পুরস্কার গ্রহনের তৈফিক দান করুন। আমীন।

প্রকাশ ঃ দৈনিক ইনকিলাব, (ইসলামী জীবন), ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০৮।
                                        











4 comments:

  1. My Prophet (sm) is innocent . He has no sin, not a single bindu. Oh Allah save me and hedayet all.

    ReplyDelete
  2. My Prophet (sm) is innocent . He has no sin, not a single bindu. Oh Allah save me and hedayet all.

    ReplyDelete
  3. সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ

    ReplyDelete