It is now

Sunday, June 23, 2013

শবেবরাতে করনীয় ও বর্জনীয়/ শবেবরাত একটি মহিমাময় রজনী





শাবনের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত এবং ১৫ই শাবানের পূর্বের রাতকে বলে লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত। অর্থাৎ নাজাতের রাত। ‘শব’ অর্থ রাত ‘বারাআতুন’ অর্থ নাজাত-নিস্কিৃতি। তাই এই রাতের নাম ‘লাইলাতুল বারাআত’ বা ‘শবে বারাআত’। সংক্ষেপে ‘শবে-বরাত।’

হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, শবে বরাতের রাতে সারা বছরের হায়াত, মওত, রিজিক ও দৌলত লেখা হয় এবং বান্দাদের আমল ঐ রাতে আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়।
রাসূল (সাঃ) উম্মতদের উপদেশ দিয়েছেন যে, “শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতে তোমরা জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদত করো এবং দিনে রোজা রেখো।”

শবে-বরাতের মাহাত্ম অপরিসীম।
 এ রাতে বান্দার প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত বর্ষিত হয়।
 আল্লাহর দরবারে বান্দার আমলসমূহ পেশ করা হয়।
 এ রাতে বিশেষ ধরনের অপরাধী ছাড়া বাকী সবাইকে মাফ করে দেয়া হয়। কিন্তু মন-প্রাণ থেকে তওবা না করা পর্যন্ত কিছু অপরাধীকে কখনই মাফ করা হয় না। তারা হলোÑমুশরিক, জাদুকর, গণক, ইর্ষাপরায়ণ, অন্যের হক নষ্টকারী, গায়ক, বাদক, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছেদকারী, পরস্পরে শত্র“তা পোষণকারী, অত্যাচারী শাসক ও তাদের সহযোগী, মিথ্যা শপথ করে পন্য বিক্রয়কারী, গর্ব সহকারে পায়ের গিরার নীচে কাপড় পরিধানকারী, মদ্যপ, পরস্ত্রীগামী, মা-বাবার অবাধ্য সন্তান, কৃপন পরনিন্দাকারী, জুয়া খেলোয়ার ইত্যাদি।

অর্থাৎ কবীরা গোনাহ সমূহ বিনা তওবায় মাফ হয় না আর ছোট-খাট বা সগীরা গোনাহ সমূহ শবে-বরাত, শবে-কদর প্রভৃতি মহিমান্বিত রাতের বরকতে মাফ হয়।

 এ রাতে জমজমের পানি সুমিষ্ট হয়।
আল্লাহ প্রতি রাতেরই শেষ তৃতীয়াংশে পৃথিবীর আসমানে শুভাগমন করেন। কিন্তু শবে বরাতের রাতে মাগরিবের সময় হতে ফজর পর্যন্ত আল্লাহ বান্দার ফরিয়াদ শোনার জন্য অপেক্ষা করেন। এ জন্যই ’শবে বরাত’ স্বমহিমায় অনন্য।

আয়শা সিদ্দীকা (রাঃ) হতে বর্ণিত এক হাদীসে আছে “একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রাত্রিতে তাহাজ্জুদের নামাজ আরম্ভ করলেন। যখন তিনি সেজদা করলেন, তখন এত দীর্ঘ সময় সেজদাতে রইলেন যে, আমি আশংকা করতে লাগলাম হয়ত তার প্রাণ বায়ু বের হয়ে গিয়েছে। আমি বিচলিত হয়ে তাঁর নিকটে গিয়ে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলী ধরে নাড়া দিলাম। তাতে তিনি নড়ে উঠলেন। আমিও নিশ্চিন্ত হয়ে নিজ স্থানে চলে গেলাম। নামাজ শেষ করে তিনি কয়েকটি কথা বলার পর এরশাদ করলেন-‘হে আয়শা আজ কোন রাত্রি তা তুমি জান কি? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রসূল অধিক জ্ঞাত। তিনি বললেন, আজ ১৫ই শা’বানের  রাত্রি (শবে-বরাত)। এ রাত্রিতে আল্লাহ পাক দুনিয়াবাসীদের প্রতি কৃপাদৃষ্টি করেন। যারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন তাদেরকে ক্ষমা করেন। যারা তাঁর দয়া ও করুনা চায়, তাদের প্রতি করুনা বর্ষন করেন। কিন্তু পরস্পর শত্র“তাকারী এ রহমত হতে বঞ্চিত হয়। এ রাত্রিতে বিশ্ববাসীর তকদীর সম্বন্ধীয় যাবতীয় বিষয়ের নথিপত্র কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে ফেরেশতাগনের কাছে সোপর্দ  করা হয়। যাতে জন্ম, আয়ু, রিজিক, সম্মান, জয়-পরাজয়, সুখ-অসুখ, দুর্যোগ, উত্থান-পতন ইত্যাদি বিষয় সন্নিবেশিত থাকে।”

অপর এক হাদীসে আছে, "আয়েশা (রাঃ) রাসূল (সাঃ) কে প্রশ্ন করেছিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এ রাতে কি আছে? তিনি এরশাদ করলেন, পরবর্তী বছর যেসব সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে, ওদের নাম এ রাতে তালিকাভুক্ত করা হয়। যে সকল আদম সন্তান এ বছর মৃত্যুবরণ করবে, তাদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। (লওহে মাহফুজে মানুষের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছু বহু পূর্বেই লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ রাতে এ বছরের কপি সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাদের হাতে অর্পণ করা হয়।) বনী আদমের আমলসমূহ আল্লাহর কাছে পাঠানো হয়। এ রাতে সকলেরই জীবিকা নির্ধারণ হয়।

হাদীসে আছে, "আয়েশা (রাঃ) রাসূল (সাঃ) কে প্রশ্ন করেছিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর রহমত ছাড়া কেউ বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না? রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করলেন, না কেউ আল্লাহর রহমত ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আপনিওকি আল্লাহর রহমত ছাড়া বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবেন না? রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘আমিও না যদি আল্লাহর রহমত আমায় আবৃত করে না লয়।"

এ পবিত্র রাতের মাহাত্মকে পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে চাইলে পূর্ব হতেই দেহ ও মন শুদ্ধ ও পবিত্র করে নিতে হবে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সবার হক আদায় করে দিতে হবে। কারো সাথে কোন অন্যায় করে থাকলে মাফ চেয়ে নিতে হবে।

অন্তরকে কলুষমুক্ত করে ভক্তি, আশা ও ইয়াকীন সহকারে মনকে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর গোলামীতে সঁপে দিতে হবে। যাবতীয় কাজে আচার-অনুষ্ঠানের চেয়ে এখলাসের দিকে বেশী নজর দিতে হবে এবং আল্লাহকে মন-প্রাণ থেকে গভীর ভাবে ডাকতে হবে। যেন আল্লাহ তা খুব দ্রুত গ্রহণ করে নেয়।

শবে বরাতে কিছু কিছু কর্মকান্ড বর্জন করা আবশ্যক। যেমনঃ আতশবাজী, প্রয়োজনাতিরিক্ত আলোকসজ্জা, গোরস্থানে মেলা ও উৎসব করা, এবাদতকে বাহ্যিক চাকচিক্য ও জাকজমকের দ্বারা অনুষ্ঠান সর্বস্ব বিষয়ে পরিণত করা।

যখন কোন কওম স্বীয় কর্মশক্তি ও ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে, তখন সে কওম এর লোকেরা কাজের চেয়ে প্রদর্শনীকে বেশী ভালোবাসে। ইদানিং আমরা দ্রুত সেদিকেই ধাŸমান হচ্ছি।

আতশবাজি এমন একটি কাজ যাতে দুনিয়া বা আখেরাতের কোন ফায়দা নেই। কেবল আছে অপব্যয় ও অপচয়। আর বিধর্মীদের অনুকরণ। ছেলেমেয়েদেরকে বুঝিয়ে বলতে হবে, যেন তারা আতশবাজি হতে সম্পূর্ণ বিরত থাকে।

হাদীসে আছে, আল্লাহর কোন নেক বান্দা যেন তার প্রতিবেশীকে অভূক্ত রেখে ঘুমুতে না যায়। তাই আমাদের উচিত শবে-বরাত সহ সারা বৎসরই পাড়া প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের খোঁজ-খবর নেয়া। গরীবদের সবসময়ই সামর্থ অনুসারে খাওয়ানো এবং অভাব অনটনে তাদের সাহায্য সহযোগীতা করা। 

শবে-বরাতে অত্যাধিক আলোকসজ্জা উচিৎ নয়। নিঃসন্দেহে এ দিনটি মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের দিন। তবে আলোকসজ্জার দ্বারা এ আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো ইসলাম কতটুকু সমর্থন করে সে বিষয়টি আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। অপচয়কারী শয়তানের ভাই। অতিরিক্ত আলোকসজ্জা নিঃসন্দেহে একটি অপচয়। আর একটি কুসংস্কার হলো কবরস্থানে মেলা বসানো ও কবরে বাতি জ্বালানো।
বাচ্চা ও ছোটদের বোঝাতে হবে ওরা যেন মসজীদে যেয়ে হট্রোগোল না করে। এতে মসজীদের আদব ও পবিত্রতা নষ্ট হয়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মসজীদে যেয়ে দৌড়াদৌড়ি ও ছুটাছুটি করলে অন্যদের এবাদত বন্দেগীতে বিঘœ ঘটে। এতে সওয়াবের বদলে গুনাহের অংশীদার হতে হয়। অনেক সময় অন্যের বিরক্তি ও বদদোয়ায় পড়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়।

শবে-বরাতে কত বেশী নামাজ পড়লাম সেটা মুখ্য বিষয় নয়। কতটা একাগ্রতা ও এখলাসের সাথে আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারলাম সেটাই মুখ্য বিষয়। মহব্বতের সাথে সামান্য পরিমাণ এবাদত গািিফলতি সহকারে অসংখ এবাদত বন্দেগী হতে শ্রেয় ও পছন্দনীয়। হাদীসে আছে, "তোমরা ঈমানকে খাঁটি কর। অল্প আমলেই নাজাদের জন্য যথেষ্ট হবে।"

নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, "তোমাদের সাধ্যানুসারে নফল এবাদতের দায়িত্ব গ্রহণ কর। যেহেতু আল্লাহতা’য়ালা পুরস্কার দানে নিরস্ত হন না, সে পর্যন্ত তোমরা ক্লান্ত হয়ে কাজে ক্ষান্ত না দাও।"

আমাদের মনে রাখতে হবে, শবে-বরাতে আল্লাহকে পেতে হলে সারাবছরই নামাজ-রোজা এবাদত বন্দেগী করে আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্ক তৈরী করতে হবে। সারাবছরে মাটির সিক্ত রস ও মুক্ত বাতাসে যে বৃক্ষ বেঁচে থাকে, বসন্তে সে বৃক্ষই ফুলে ফুলে সজ্জিত হয়। শরীরে ময়লা থাকলে তা ধুয়ে মুছে পরিস্কার না করলে অধিক সুগন্ধীযুক্ত আতরই কি কোন কাজে আসবে? আল্লাহর অবাধ্যতা পরিহার করে তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনই শবে-বরাতের মূলকথা।

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসে আছে যে, নবী করীম (সাঃ) একটি দোয়া তাঁকে শিখিয়েছেন এবং অন্যকেও শিক্ষা দেয়ার জন্য বলেছেন এবং নামাজের সেজদায় বারবার একটি দোয়া পাঠ করার উপদেশ দিয়েছেন। নবী করীম (সাঃ) এভাবে দোয়াটি পড়তেন,  “হে আল্লাহ! আমার কল্পনা, আমার অন্তর তোমাকে সেজদা করছে। আমার মন তোমার দরবারে সেজদারত অবনত। হে আল্লাহ! তুমি জান আমি নিজে নিজের উপর অত্যাচার করেছি। হে মহান, হে শ্রেষ্ঠতম! তুমিই যাবতীয় মহান কার্যাবলীর ভরসাস্থল। আমার পাপ মার্জনা কর! হে আল্লাহ আমি আমার ললাট দ্বারা সেজদা করেছি। যে ললাটের তুমিই চিত্রকর। তুমিই স্রষ্ঠা। হে আল্লাহ! তুমিই কান ও নয়ন দান করেছ। এ পর্যন্ত বলে সেজদা হতে মাথা তুললেন এবং পুনরায় সেজদায় নতশির হয়ে বলতে লাগলেন,‘হে আল্লাহ! তোমার ক্রোধ হতে নিস্তার চাই। তোমার সন্তুষ্টি প্রার্থনা করি। তোমার শাস্তি হতে পরিত্রাণ চাই। তোমার মার্জনা ও করুনা ভিক্ষা করি। হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয়প্রার্থী, আমি তোমার প্রচুর গুণ-কীর্তন করছি। যেরুপ তুমি নিজেই নিজের গুণ বর্ণনা করছো। আর তোমার ভাই দাউদ (আঃ) যেরুপ দোয়া করেছিলেন আমি তদ্রুপ দোয়া করছি। হে আল্লাহ! আমাকে এরুপ অন্তর দান কর যে অন্তরে শিরকের কণা পরিমান চিহ্ন না থাকে। যে অন্তর পাপকার্য, ফাসেকী ও কঠোরতা হতে উর্ধ্বে থাকে।”

হাদীসে আরো বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি যিলহজ্জ মাসের আট, নয় তারিখ, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহার রাত্রি এবং শবে-বরাত এই পাঁচটি রজনীতে জাগ্রত থেকে এবাদত করবে, তার জন্য জান্নাতে প্রবেশ করা ওয়াজিব হয়ে যাবে।
আল্লাহ আমাদেরকে সকল নেক আমল করার তৈফিক দান করুন। আমীন।

প্রকাশঃ দৈনিক ইনকিলাব (ধর্ম-দর্শন), ১৪ আগষ্ট, ২০০৮।

No comments:

Post a Comment