It is now

Sunday, April 21, 2013

ইসলাম ধর্মে সালামের তাৎপর্য / সালামও এক ইবাদত


লেখক ঃ খন্দকার নাজনীন সুলতানা

'আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহ্মাতুল্লাহে ওয়া বারাকাতুহু'। আপনার উপর আল্লাহর অশেষ রহমত বর্ষিত হোক। আপনি সকল প্রকার দুঃখ-কষ্ট, বালা-মসিবত, বিপদাপদ হতে নিরাপদ ও শান্তিতে থাকুন।' কি অপূর্ব সুন্দরতম, হৃদয় প্রশান্তিকর এই দোয়া। প্রতিটি মুসলমান অপর মুসলমানের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ বা আলাপচারিতার প্রারম্ভেই এরূপ সালাম দেয়ার নিয়ম।এটাই ইসলামের বিধান।


ইসলামপূর্ব জাহিলিয়্যাতের যুগে প্রাচীন আরবের অধিবাসীরা পরস্পর মিলিত হলে অভিবাদনস্বরূপ বলতো হাইয়্যাকাল্লাহু। অর্থাৎ আল্লাহ তোমায় দীর্ঘজীবী করুন। পরবর্তীতে ইসলামের প্রারম্ভে মহানবী (সাঃ)-এর মক্কীজীবনের শুরুতে আল্লাহর আদেশে নবী কারীম (সাঃ) সকলকে সালামের আদেশ দেন। তখন থেকেই ইসলামে শুদ্ধ ও সঠিকভাবে সালামের প্রচলন ঘটে।

হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসে পাই, তিনি বলেনÑ "আমি মহানবী (সাঃ) এর দরবারে হাজির হলে তিনি আমাকে 'আস্সালামু আলাইকুম' বলে অভিবাদন জানালেন। তখন আমি উত্তরে বললাম,ওয়া আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্। অতঃপর হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) বলেন, "ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম যাকে সালাম দেয়া হয়,আমিই সেই ব্যক্তি।" (ফাতহুল বারী, ১১: পৃষ্ঠা ৪)

সালাম একাধারে দোয়া ও ইবাদত। হযরত উমর (রাঃ) হতে বর্নিত এক হাদীসে পাই-'জনৈক ব্যক্তি প্রিয় নবীজী মহানবী (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, ইসলামের সর্বোত্তম আমল কি ? উত্তরে তিনি বললেন, "ক্ষুধার্তদের খাবার খাওয়ানো এবং চেনা-অচেনা সকলকে সালাম দেয়া।" (আবু দাউদ)

আমাদের উচিৎ পরিবারে ও পরিবারের বাইরে বেশি বেশি সালামের প্রচলন করা। নিজেরা পরস্পর সালাম আদান-প্রদান করা এবং অন্যদের সালাম দিতে উৎসাহিত করা। পরিবারে মা-বাবা ও মুরুব্বীদের উচিৎ ছোটবেলা থেকেই শিশুদেরকে শুদ্ধ রুপে ও সঠিক নিয়মে সালাম দেয়ার শিক্ষা দেয়া। অনেকে খুব দ্রুত বলেন, 'স্লামালাইকুম'।এর কোন অর্থ হয় না, তাই এরূপ বলা উচিৎ নয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, "যখন তোমাদেরকে সালাম দেয়া হয়, তখন তোমরা তার চেয়ে উত্তম অথবা অনুরূপ সালাম দ্ধারা তার উত্তর দাও।" (সূরা নিসা, আয়াত নং ৮৬)

সালাম আদান-প্রদানে পরস্পরের প্রতি স্নেহ, মায়া-মমতা ও ভালবাসা সৃষ্টি হয়।এবং উপ¯িহত শ্রোতাদের উপর এর অপরূপ সুন্দর প্রভাব পড়ে।

হযরত আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-"রাসুল কারীম (সাঃ) বলেছেন, সে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক নিকটবর্তী যে প্রথমে সালাম দেয়।"(আহ্মদ, তিরমিযী, আবু দাউদ)

হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-"রাসুল কারীম (সাঃ) বলেছেন, "কথাবার্তা বলার আগেই সালাম দিতে হয়। (তিরমিযী)

শিশুদেরকে সালাম শিক্ষা দেবার উত্তম পন্থা হলো, শিশুদের সাথে দেখা হলে বড়রাই প্রথমে তাদের সালাম দেবেন। কোমলমতি ও অনুকরণপ্রিয় শিশুদের মনে এই ব্যাপারটি দারুণ প্রভাব ফেলবে। এতে শিশুরা খুব দ্রুত সালাম আদান প্রদানে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। নিস্পাপ শিশুরা কচিকন্ঠে যখন সালাম দেবে, তখন শুনতেও অত্যন্ত আকর্ষণীয়, মজদার, ও হৃদয়গ্রাহী হবে। আল্লাহ্ও খুব খুশি হবেন। সালাম আদান-প্রদান "নবী কারীম (সাঃ)-এর আদর্শ ও সুন্নত।

আনাস (রাঃ) হতে বর্নিত এক হাদীসে আছে, " হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) একবার একদল শিশু-কিশোরদের কাছ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন, তখন তিনি তাদেরকে সালাম দিলেন।"(মুসলিম শরীফ ২য় খন্ড)
তাই হযরত আনাস (রাঃ)ও ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের সাথে দেখা সাক্ষাত হলে সালাম দিতেন।

বড়রা উদার মন নিয়ে বিনম্রভাবে হাসতে হাসতে শিশুদেরকে সালাম দিলে শিশুরাও অন্যকে দ্রুত সালাম দিতে অভ্যস্ত হবে। শিশুদের মাঝে ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি জাগ্রত হবে। শিশুদের পক্ষ থেকে বড়দেরকে শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের মন-মানসিকতা সৃষ্টি হবে।

সালাম দেবার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে শিশু সজাগ হবে। পরস্পরের মাঝে দোয়া বিনিময়ের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে।

 শিশুরা কাদামাটির ন্যায় নরম ও কোমল। ওদেরকে শেখানো খুবই সহজ ও ফলপ্রসু। প্রতিটি শিশু যখন সৌজন্যমূলক আচার-আচরণ ও নিয়ম-নীতিতে অভ্যস্ত হবে, তখন পরবর্তী প্রজন্ম খুব সহজেই সঠিক ও নির্ভুল পথে অগ্রসর হতে অভ্যস্ত হবে।

প্রতিটি গৃহ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জনসমাবেশ, অফিস-আদালত সর্বত্রই সালাম আদান-প্রদানে সকলকে উৎসাহিত করা উচিৎ। হযরত কাতাদাহ (রাঃ) হতে বর্নিত হাদীসে পাই, " হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করবে, তখন গৃহবাসীকে সালাম দিবে।  আর যখন বের হবে, তখনও গৃহবাসীকে সালাম দিয়ে বিদায় নেবে।"(বায়হাকী)

ইসলাম ধর্মের সালাম যতটুকু ব্যাপক অর্থবোধক ও মাহাত্মপূর্ণ অন্য কোন ধর্মের স্বাগতম ও আদাব বিনিময়ের মাহাত্ম্য এরূপ নয়। সালামে শুধু ভালোবাসাই প্রকাশ পায় না, বরং আল্লাহর কাছে এই দোয়াও করা হয় যে, আল্লাহ আপনাকে সকল প্রকার দুঃখ-কষ্ঠ, বালা-মসিবত ও বিপদ-আপদ হতে নিরাপদ ও শান্তিতে রাখুক।

সালামে এরূপ অভিব্যক্তিও রয়েছে যে, আমরা সবাই আল্লাহর মুখাপেক্ষী। তাঁর রহমত ব্যতীত আমরা একে অপরের উপকারও করতে পারি না। সালাম এক অর্থে এবাদত এবং অপরদিকে অপর মুসলিম ভাইকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার উপায়ও বটে। আবার সালামের মাঝে এ ওয়াদাও করা হয় যে, আমার হাত ও মুখের অনিষ্ট হতে তুমি নিরাপদ। তোমার জানমাল ও ইজ্জত আবরুও আমি সংরক্ষণ করবো ইনশাআল্লাহ।

সালামের মাহাত্ম্য সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্নিত এক হাদীসে পাই-" হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা ঈমান গ্রহণ করবে। ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমান লাভ করতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন কথা বলবো, যাতে তোমাদের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে ? তোমরা পরস্পরের মাঝে সালামের ব্যাপক প্রচলন করবে। (মুসলিম, আবু দাউদ)

অপর এক হাদীসে নবী কারীম (সাঃ) ইরশাদ করেন,"তোমরা করুনাময় আল্লাহতা'লার ইবাদত কর এবং সালামের ব্যাপক প্রচলন কর।"

আজ থেকে অফিসে আপনার জুনিয়র কর্মকর্তা, কর্মচারী, পিয়ন, দারোয়ান সবাইকে আগেভাগে সালাম দিয়ে দেখুনইনা ওরা কি খুশি হয় ? নিশ্চিত ওরা সবাইকে বলে বেড়াবে যে, আমার বস কি ভালো। এমন ভালো, অমায়িক, হাসিখুশি মানুষ কমই দেখেছি। আরো কত্ত কত্ত প্রসংশা। আরে সালাম দিতে তো আর পয়সা লাগে না, একটু তড়িঘড়ি করে সবার আগে সালাম দিয়ে দেখুনই না। ঠকবেন না ইনশাআল্লাহ্, জিতবেনই। আর বড়দেরকে সালামতো দিতেই হবে। তা না হলে বেয়াদপী হবে যে।

ঘুম থেকে উঠে স্ত্রী বা স্বামীকে প্রথমেই সালাম দিন। দেখবেন, স্ত্রী আপনার উপর অভিমান করে থাকলেও ফিক্ করে হেসে দেবে। এতে স্বামী-স্ত্রীর মিল মহব্বত অনেক বৃদ্ধি পাবে। তখন আপন ঘরেই বেহেশতের সুশীতল বাতাস বইতে থাকবে।

বাসা থেকে অফিসে যাবার সময় বাসার সবাইকে সালাম দিন। দেখবেন বাসার সকলের সারাটি দিন বেশ ভালোই কাটবে। আপনার শিশুও স্কুলে যেয়ে সবার আগে সবাইকে সালাম দেবে। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে সব শিশুরাই আপনার শিশুর বন্ধু হয়ে উঠবে।

কাজেই ছোট-বড় সবাইকে সালাম দিন। অন্যদেরও সালাম দিতে অভ্যস্ত করুন। নিষ্কলুষভাবে, পবিত্রভাবে প্রাণভরে সবাইকে ভালোবাসুন। দেখবেন অন্যরাও আপনাকে কত্ত ভালোবাসে।

হাদীসে আছে, "যে ব্যক্তি সালাম দিতে কার্পণ্য করে সে কৃপণ বলে গণ্য হবে।" অন্য এক হাদীসে আছে, "যে ব্যক্তি প্রথমে সালাম দেয়, সে অহঙ্কারমুক্ত।"

আর অহঙ্কার এমন একটি আবরণ যা মানুষের সকল মহত্ত্ব আবৃত করে ফেলে। বাদশাহ সোলেমান এর কথা-"অহঙ্কার মানুষের পতন ঘটায়। কিন্তু বিনয় মানুষের মাথায় সম্মানের মুকুট পরায়।" তাই মনের মাঝে বিন্দুমাত্র অহঙ্কারও যদি থাকে তা ত্যাগ করুন ও ছোট-বড় সবাইকে সালাম দিন।

'আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহ্মাতুল্লাহে ওয়া বারাকাতুহু'।

প্রকাশ: দৈনিক ইনকিলাব (ইসলামী জীবন), ১৮ আগস্ট ২০০৯।

No comments:

Post a Comment