It is now

Tuesday, March 5, 2013

১. রোজা ও স্বল্প আহারেই দেহ-মন সুস্থ/ রোজা দেহ ও মনের সুস্থতার নিয়ামক

      
বইয়ের নামঃ ফী ত্বলাবুল জান্নাত (জান্নাতের খোঁজে)
লেখক ঃ খন্দকার নাজনীন সুলতানা

১. রোজা ও স্বল্প আহারেই দেহ-মন সুস্থ/ রোজা দেহ ও মনের সুস্থতার নিয়ামক

          
হুযুরে পাক (সাঃ) বলেচেন, ‘অল্প হাস্য এবং অল্প আহার করে হৃদয়কে সজীব কর এবং ক্ষুধা দ্বারা তাকে পবিত্র কর। যে ব্যক্তি উদরকে ক্ষুধিত রাখে, তার চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি হয় এবং হৃদয় প্রখর ও সতেজ হয়।’

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, হুযুরে পাক (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি পরিতৃপ্ত আহার করে এবং নিদ্রা যায়, তার হৃদয় কঠিন হয়। প্রত্যেক বস্তুরই যাকাত আছে। শরীরের যাকাত হলো ক্ষুধা।”

হুযুরে পাক (সাঃ) আরো এরশাদ করেছেন, “ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা দ্বারা তোমরা তোমাদের প্রবৃত্তির সাথে লড়াই কর। কেননা তার মধ্যে পূন্য রয়েছে।”

বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসাবিদ ইবনে সীনা তাঁর রোগীদেরকে তিন সপ্তাহ রোযা থাকার নির্দেশ দিতেন। রোগ নিরাময়ের যতগুলো প্রতিরোধক ও প্রতিকার আছে, রোযা তম্মধ্যে সবচেয়ে বেশী কার্যকর ও ফলপ্রসু। সারা বছর অধিক ভোজনের ফলে দেহে যে জৈববিষ বা টক্্িরন জমা হয়, তা স্নায়ু এবং অপরাপর জীবকোষগুলোকে দূর্বল করে দেয়। রোযার মাধ্যমেই ঐ সব জৈববিষ সমূহ দূরীভূত করা সহজ হয়।
চিকিৎসাবিদগণ বলেছেনÑ যখনই একবেলা খাবার বন্ধ থাকে, তখনই দেহ সেই মুহুর্তটিকে রোগ মুক্তির সাধনায় নিয়োজিত করে।

ক্ষুধা আত্মাকে নির্মল ও পরিস্কার করে, স্বভাবকে সতেজ করে এবং দৃষ্টিকে সূক্ষ্ম করে। পক্ষান্তরে পরিতৃপ্ত আহারে অলসতা জম্মায়। যে ব্যক্তি অতিরিক্ত আহার করে তার স্মরণশক্তি অকর্মন্য হয়ে যায়, তার বুদ্ধি হ্রাস পায় এবং সে নির্বোধ ও বোকা হয়ে যায়।

হুযুরে পাক (সাঃ) বলেছেন, ‘ক্ষুধাই হেকমতের নূর, পরিতৃপ্ত আহার আল্লাহকে দূরে রাখে। দরিদ্রের প্রতি ভালবাসা এবং তাদের নিকটবর্তী হওয়াই আল্লাহকে নিকটে নিয়ে আসে। তৃপ্তিসহকারে আহার করো না, তাতে হেকমতের নূর তোমাদের হৃদয় থেকে নির্বাপিত হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি অল্প আহার করে রাত কাটিয়ে দেয়, ভোর পর্যন্ত নূর তার চারদিকে বিচরন করে।’

হযরত শিবলী (রহ:) বলেছেন, “আমি যেদিনই আল্লাহর সন্তুষ্টিকল্পে ক্ষুধার্ত ছিলাম, সেদিনই আমি দেখেছিলাম যে, আমার হৃদয় হেকমত এবং উপদেশের দিকে এমনভাবে উম্মুক্ত হয়েছে যে, আমি তা অন্য কখনও দেখি নি।”

হযরত আবু ইয়াযিদ (রহ:) বলেছেন, 'ক্ষুধা মেঘ সদৃশ, যখন কোন ব্যক্তি ক্ষুধার্ত হয়, হৃদয় তখন হেকমতের বৃষ্টি বর্ষন করে।' বর্তমানে এক শ্রেণীর উচ্চ ডিগ্রিধারী ও অত্যাধুনিক ব্যক্তিরা রোজাকে অস্বীকার করে এবং রোযা রাখার কোন গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে না। এমনকি রোযাকে তারা দেহ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলেও অপপ্রচার করে থাকে। অনেক চিকিৎসকও গ্যাস্ট্রিক, আলসার, হাইপার এসিডিটি প্রভৃতি রোগীদেরকে রোজা রাখতে বারণ করে থাকে।

অথচ রোযার আর এক উপকার হলো স্বাস্থ্য রক্ষা ও ব্যাধির বিলুপ্তি। অল্প আহারে স্বাস্থ্য রক্ষা হয় এবং রোগব্যধি দূর হয়। অতিরিক্ত ভোজনই হাজারো রোগের কারণ।

এ প্রসঙ্গে একটি সত্যি ঘটনার অবতারনা করা যায়। খলিফা হারুনুর রশীদ একসময় ভারতবর্ষ, রোম, ইরাক এবং আবিসিনিয়া দেশ থেকে চারজন চিকিৎসক সংগ্রহ করে তাদেরকে বলেলেন, ‘আপনাদের মধ্যে প্রত্যেকেই আমাকে এমন ঔষধ দেবেন, যাতে আমার আর কোন রোগ না হয়।’

ভারতবর্ষের চিকিৎসক বললেন, ‘সে ঔষধ হলো “কাল আহলীজ।” ইরাকের চিকিৎসক বললেন, ‘তা স্বেত বর্ণের হেলেঞ্চার দানা। রোমের চিকিৎসক বললেন, ‘তা গরম পানি।’ হাবসার চিকিৎসক সর্বাপেক্ষা অভিজ্ঞ ছিলেন। তিনি বললেন, ‘আহলীজ ঔষধে পাকস্থলী সংকীর্ণ হয়ে যায়। এটাও একপ্রকার রোগ জন্মায়। হেলেঞ্চার দানা পাকস্থলীকে নরম করে এবং এটাও এক প্রকার রোগ জন্মায়। গরম পানিও পাকস্থলীকে নরম করে, এটাও এক প্রকার ব্যধির জন্ম দেয়। তখন অন্যান্য চিকিৎসকগন তার কাছে কি ঔষধ আছে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘খলিফার জন্য আমার ঔষধ হলো, ‘ক্ষুধা না হলে তিনি যেন আহার না করেন এবং আহারের সময় কিছু ক্ষুধা বাকী থাকতেই যেন আহার থেকে হাত উঠিয়ে নেন।’ তখন তারা সবাই একযোগে স্বীকার করলেন যে, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন।’  (এহইয়াউ উলূমিদ্দীন)

হাদীসে আছে, নবীকরীম (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা উদরের এক তৃতীয়াংশ খাদ্য দ্বারা, এক তৃতীয়াংশ পানি দ্বারা পূর্ণ কর ও এক তৃতীয়াংশ নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের জন্য ফাঁকা রাখো।’
হুযুর পাক (সাঃ) আরো বলেছেন, 'ভুরীভোজন রোগের মূল এবং পানাহারের নিয়ন্ত্রণ নিরোগ থাকার মূল।'

হযরত ইবনে সালেম (রহঃ) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি বিশুদ্ধ যবের রুটি নিয়মানুযায়ী ভক্ষণ করে, তাকে মৃত্যু রোগ ব্যতীত অন্য কোন রোগ আক্রমন করতে পারে না।’ তাকে জিজ্ঞেস করা হল, নিয়মানুযায়ী ভক্ষণ করার অর্থ কি? তিনি বললেন, ‘ক্ষুধা পাবার পরে আহার করা এবং উদর তৃপ্ত না করেই ভক্ষণ শেষ করা।’

দেহ ও আত্মা উভয়ের সুস্থ্যতার জন্যই রোজার ভূমিকা অপরিসীম। একমাত্র রোযার মাধ্যমে পাকস্থলী বিশ্রাম পায়। রোযা শরীরের রক্ত প্রবাহকে পরিশোধন করে। উচ্চরক্ত চাপ জনিত ব্যাধি ও পেপেটিক আলসার যৌনাঙ্গ ও অন্ডকোষের বিবিধ রোগের উপশমের ক্ষেত্রে রোজার বিকল্প নেই।

প্রসিদ্ধ চিকিৎসক ডঃ ডিউ বলেছেন, “রোগক্লিষ্ট মানুষটির পাকস্থলী থেকে খাদ্য দ্রব্য সরিয়ে ফেল, দেখবে রুগ্œ মানুষটি উপবাস থাকছে না। মূলতঃ উপবাস থাকছে রোগটি।

রোযায় হৃদয় কোমল ও নির্মল হয়। এতে যিকির ও মোনাজাতের মিষ্টি আস্বাদ সুন্দর ভাবে অনুভব করা যায়। হযরত আবু সোলায়মান দারানী (রহঃ) বলেছেন, 'যখন আমার পিঠ উদরের সাথে লেগে গিয়েছিল, তখনই আমি ইবাদতে আস্বাদ পেয়েছি।'

হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রহঃ) বলেছেন, "যে ব্যক্তি তার ও তার বক্ষের মধ্যবর্তী স্থানে খাদ্যের ডালা স্থাপন করে মুনাজাতের আস্বাদ পেতে চায়, তার আশা সফল হবে না। তিনি আরো বলেছেন, যখন উদর ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হয় তখন তা নির্মল ও কোমল হয়, যখন তা পরিতৃপ্ত আহারে তুষ্ট হয়, তখন তা অন্ধ ও কঠিন হয়। যখন হৃদয় মুনাজাতের স্বাদ পায় তখন আল্লাহর বিষয়ে চিন্তা করা সহজ হয় এবং মারেফাতে তত্ত্বজ্ঞান বৃদ্ধি পায়।"

রোযা দ্বারা যত সহজে প্রবৃত্তিকে বশীভূত করা যায়, অন্য কিছুর দ্বারা ততটা সম্ভব হয় না। রোযায় দীনতা উপলব্ধি করা যায়, মিথ্যা অহঙ্কাার ও আমোদ-প্রমোদ দূরীভূত হয়। ফলে আল্লাহর কাছাকাছি যাওয়া সহজ হয়।

এজন্যই হুযুরে পাক (সাঃ) এর সম্মুখে দুনিয়ার সকল ধনসম্পদ উপস্থিত করা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, “আমি একদিন ক্ষুধার্ত থাকা ও তার পরদিন আহার করাকে পছন্দ করি। যেদিন ক্ষুধার্ত থাকবো, সেদিন আমি ধৈর্যের সাথে বিনম্র হব। যেদিন আহার করবো, সেদিন আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো।’

ইমাম গাযযালী (রহঃ)Ñ এর মতে, ‘উদর এবং কামরিপু দোযখের দরজা। এর মূল হলো ভূরিভোজন, নম্রতা এবং ভগ্নহৃদয়তা বেহেশতের দরজা। এর মূল হলো ক্ষুধা। যে ব্যক্তি দোষখের দরজা বন্ধ করে দেয়, সে নিশ্চয়ই তখন বেহেশতের দরজা উম্মুক্ত করে। কেননা উভয় দরজাই পূর্ব ও পশ্চিমের ন্যায়। পরস্পর মুখোমুখি। কেউ এক দরজার নিকটবর্তী হলে অন্য দরজা হতে দূরবতী হতেই হয়।’  
রক্ত, স্নায়ু ও দেহের গ্রন্থিসমূহের উপর রোজার সুফল ও প্রতিক্রিয়া সর্বাধিক। রোজা মস্তিস্ক ও স্নায়ুতন্ত্রকে সর্বাধিক উজ্জীবিত করে। এতে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল ভাবে চিন্তা-ভাবনা করা সহজ হয়। রোজা মস্তিষ্কের কোষগুলোকে জীবানুমুক্ত করে ও স্বচ্ছ রক্ত প্রবাহে সাহায্য করে। ফলে মস্তিষ্ক গভীর ও ব্যাপক ভাবে চিন্তা-ভাবনা করার শক্তি অর্জন করে।

জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত অমূল্য সম্পদ। এই পৃথিবী নামক পরীক্ষাক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই আমরা হাজারো পরীক্ষার সম্মুখীন হচ্ছি। জীবন ভোগের জন্য নয়, ত্যাগের জন্য। আর এই ত্যাগ চর্চার অন্যতম মাধ্যমই হচ্ছে রোজা। রোজায় ইবাদত করা সহজ হয়। অতিরিক্ত ভোজনে ইবাদতে বিঘœ ঘটে।

হযরত আবু সোলায়মান দারানী (রহঃ) পরিতৃপ্ত ভোজনের ছয়টি আপদের কথা উল্লেখ করেছেন। "তাঁর মতে, (১) পরিতৃপ্ত ভোজনে মুনাজাতের আস্বাদ পায় না। (২) হেকমত বা বিজ্ঞানের বিষয় স্মরণ রাখতে পারে না। (৩) লোকজনের উপর দয়া প্রদর্শনের গুন লোপ পায়। কারণ সে মনে করে সবাই নিশ্চই তার মত উদর পূর্ণ করে আহার করেছে। (৪) ইবাদত কার্যে সে কষ্ট অনুভব করে। (৫) কামপ্রবৃত্তি ও লালসা তার মনে প্রবল হয়। (৬) যে সময়ে অন্যান্য মুছল্লীগন মসজিদে যাতায়াত করে, সে সেই সময়ে পায়খানায় আবদ্ধ থাকে।" 

খাওয়ার জন্য বাঁচা নয়, বাঁচার জন্য খাওয়া, এই যেন হয় আমাদের আদর্শ। হযরত ছহল তশতরী (রহঃ) কে তাঁর আহারের পরিমান সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি উত্তরে বলেছেন, “তিন দেরহাম ব্যয়ে আমার সারা বছরের আহারের ব্যবস্থা হয়ে যেত। এক দেরহাম দিয়ে আটা কিনতাম এক দেরহাম দিয়ে মিহিন চাল আর এক দেরহাম দিয়ে ঘি কিনতাম। সবগুলো মিলিয়ে তিনশ ষাটটি লাড্ডু তৈরী করে নিতাম। প্রতিদিন সন্ধায় ইফতার করে এক এক লাড্ডু ভক্ষন করতাম।’ তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, এখনওকি আপনার তদ্রুপ অভ্যাস আছে? তিনি বললেন, ‘এখন কোন সীমা নাই, কিছু পেলে খাই, না পেলে ধৈর্য ধারন করি।’

হযরত আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) বলেন, “হুযুরে পাক (সাঃ) যদি প্রাতে আহার করতেন, তবে রাতের বেলা আর কিছু খেতেন না, রাতের বেলায় আহার করলে তার পরদিন ভোরে আর কিছু খেতেন না।”
হাদীসে আছে, হুজুরে পাক (সাঃ) হযরত আয়শা (রাঃ) কে বলেছিলেন, “হে আয়শা! খবরদার অপচয় করো না। দুবেলা আহারে অপচয় হয়।”

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আরো বলেছেন, “আমার উম্মতদের মধ্যে যাদের আহার উপাদেয় খাদ্য এবং যাদের দেহ তার উপরই বর্ধিত, যাদের নানা প্রকার খাদ্য এবং বেশভূষাই চরম লক্ষ্য, যারা দীর্ঘ সময় অনর্থক বাক্য ব্যয় করে তারা জঘন্য।”

হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বলেন, মু’মিন ব্যক্তি মেষের ন্যায়। এক মুষ্টি শাক, এক মুষ্টি ছাতু আর এক অঞ্জলী পানিই তার জন্য যথেষ্ট। পক্ষান্তরে, মুনাফিক হিংস্র পশুর ন্যায় গলিত মাংস চর্বন করে। আনন্দে বিচরন করে এবং সে বহু পরিমান খাদ্য আহার করে। সে তার ভ্রাতার জন্য উদ্ধৃত্ত খাদ্য রেখে দেয় না।

মুমিন ব্যক্তি শুধু জীবন রক্ষার তাগিদেই আহার করে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, 'আহার কর, পান কর কিন্তু অপব্যয় করো না।' অথচ অধিকাংশ লোকই খাদ্য অপব্যয় করে। ক্ষুধা না লাগলে খাওয়াটাও একটা অপব্যয়।
ইমাম গাযযালী (রহঃ)Ñ এর মতে, 'সত্য বা প্রকৃত ক্ষুধা চিনে নেয়ার কিছু কৌশল বা উপায় রয়েছে। প্রথম কৌশল হল, ব্যঞ্জন ছাড়াও আহার করার ইচ্ছা হওয়া। অন্নের সাথে তরকারী বা মাছ-মাংসের অনুসন্ধান করলে তখন বুঝতে হবে যে, প্রকৃত ক্ষুধা হয় নি। দ্বিতীয় কৌশল হল আহারের ব্যঞ্জন পাত্র বা বরতন থেকে এমন ভাবে চেটে খাওয়া যেন তাতে মাছি না পড়ে।” ভালোভাবে বর্তন চেটে খেলেই বুঝতে হবে, আরো একটু ক্ষুধা বাকী আছে।”

আর মু’মিন বান্দাদের সবসময়ই পেটে কিছুটা ক্ষুধা রাখা উচিৎ। কারণ ব্যক্তি ক্ষুধার্থ ও তৃষ্ণার্থ থাকলেই তার পক্ষে পরকালে দোযখীদের ক্ষুধার কথা স্বরণ করা সহজ হয়। ক্ষুধাই উত্তম দুঃখ ও কষ্ট। নবী ও আওলিয়াগন যেসব দুঃখ-কষ্ট দ্বারা পরীক্ষিত হয়েছিলেন, তম্মধ্যে ক্ষুধা অন্যতম।

 একবার হযরত ইউসুফ (আঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “আপনার হস্তে রাজ্যের ধন-রতœ থাকা সত্ত্বেও আপনি কেন ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছেন? তদুত্তরে তিনি বললেন, “পরিতৃপ্ত আহার করলে আমার ভয় হয় যে, ক্ষুধিত জনের ও দরিদ্রদের কষ্ট ভুলে যেতে পারি। এটা ক্ষুধার একটি উপকারিতা। কেননা তা মানুষের উপর দয়া, খাদ্য প্রদান এবং সহানুভূতি শিক্ষা দেয়। যারা পরিতৃপ্ত আহার করে, তারা ক্ষুধার্থের ক্লেশের বিষয় ভুলে থাকে।”

রোযায় মানুষের মানবিক অধিকার ও অনুভূতিগুলো খুব তীক্ষè হয়। স্বরণ শক্তি বৃদ্ধি পায়। মনোসংযোগ ও যুক্তিশক্তি বাড়ে। ঘ্রাণ শক্তি, দৃষ্টি শক্তি, শ্রবণ শক্তিও বহুগুনে বেড়ে যায়। রোযায় পাপ প্রবৃত্তি দমন থাকে। ক্ষুধা পাপের সব লোভ লালসাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে এবং নফসে আম্মারাহ বা অসৎ প্রবৃত্তিগুলোকে বশীভূত করে রাখে।

খারাপ প্রবৃত্তি দমনের ক্ষমতা লাভই সব সৌভাগ্যের মূল এবং প্রবৃত্তির অধীন হওয়াকেই সব দূর্ভাগ্যের মূল বলা হয়। আর দুধর্ষ প্রবৃত্তিগুলোকে দমন করতে রোযার ভূমিকা অপরিসীম।

হযরত যুননূন মিসরী (রহঃ) বলেছেন, “যখনই আমি তৃপ্তির সাথে আহার করেছি, তখনই আমার মনে পাপ বা পাপের খেয়াল উদয় হয়েছে।”

হযরত আয়শা (রাঃ) বলেছেন, “হুযুরে পাক (সাঃ)Ñ এর পরলোক গমনের পর সর্বপ্রথম যে বেদয়াত সৃষ্টি হয়েছিল, তা’হল পরিতৃপ্ত আহার।”

যেসব লোক উদর পূর্ণ করে ভোজন করে তাদের প্রবৃত্তিগুলো সবসময় তাদেরকে সংসারের দিকে আকর্ষিত করে রাখে ও পরকালকে ভুলিয়ে রাখে।

জনৈক মহাপুরুষ বলেছেন, “আল্লাহতা’লার রতœভান্ডারের মহারতœ হলো ক্ষুধা। ক্ষুধা দ্বারা সর্বাপেক্ষা নূনতম যে আপদ দূর করা যায়, তা’হল কামরিপু, প্রবৃত্তি এবং বলার আকাঙ্খা। ক্ষুধার্থ ব্যক্তি অতিরিক্ত কথা বলতে চায় না। তাই সে পরনিন্দা, অশ্লীল বাক্য, মিথ্যা কথা ইত্যাদি রসনার দোষ হতে মুক্তি পায়।”

অতিভোজনের ফলে অনেকেরই পাকস্থলী বড় হয়ে যায়। রোযা রাখলে এই পাকস্থলী আবার ধীরে ধীরে স্ব অবস্থানে ফিরে আসে। রোযায় পরিপাকতন্ত্র বিশ্রামে থাকে ও জীবানুমুক্ত থাকে। বৃহদাকার যন্ত্র এই পাকস্থলীর বিশ্রামের অন্যতম মাধ্যমও হলো রোযা। তৃপ্তিসহকারে ভোজনে মানুষের পশুপ্রবৃত্তি বেড়ে যায়। এ সম্পর্কে ইমাম গাযযালী (রহঃ) বলেছেন, যখন মানুষ তৃপ্তি সহকারে ভোজন করে, তখন সে কামইন্দ্রিয়কে দমন রাখতে পারে না। যদি আল্লাহর ভয়ে তা দমন করে রাখেও তবে, চোখের ব্যভিচার করতে থাকে। যদি চোখকে সে এদিক সেদিকে কুদৃষ্টি থেকে ফিরিয়েও রাখে, কিন্তু সে মনকে দমন করতে পারে না। নানা কুচিন্তা ও অসৎ খেয়াল তার মনে আসে। মুনাজাতে সে আস্বাদ পায় না। অনেক সময় নামাজের মধ্যেও বহুবিধ চিন্তা এসে জড় হয়ে থাকে।”

অর্থাৎ রোজার দ্বারাই মানুষের দেহ ও মন দুইই সুস্থ, সবল ও স্বাভাবিক রাখা সম্ভব। আয়ু মানুষের জীবনের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান বস্তু। মানুষের ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি হতেও আয়ু অধিক মূল্যবান। আর নিদ্রা মৃত্যুস্বরুপ। রোযায় ঘুমানোর জন্য কম সময় ব্যয় হয় ও ইবাদতের জন্য বেশী সময় পাওয়া যায়। রোজা ও স্বল্প আহারের গুরুত্ব অপরিসীম।

হযরত সাররী ছাকতী (রহ:) বলেছেন, “হযরত আলী (রাঃ) জুরজানী (রহ:) কে যবের ছাতু পানিতে গুলে পান করতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কেন এরুপ কষ্ট করছেন? তিনি বললেন, রুটি চিবিয়ে খেতে যে সময় লাগে, সে সময়ের মধ্যে আমি সত্তরবার তাসবীহ পড়তে পারবো। সেজন্য বিগত চল্লিশ বছর ধরে আমি রুটি খাইনি।

জীবনের প্রতিটি নি:শ্বাস অমূল্য রতœ। তার যথাযথ সদ্ব্যবহার করতঃ পরকালের জন্য ধন সম্পদ সঞ্চয় করা উচিৎ। এজন্যই যিকির ও ইবাদতেই জীবনের বেশীরভাগ সময় ব্যয় করা বুদ্ধিমানের কাজ। যিকির ও ইবাদতের জন্য সারাদিন জায়নামাযে বসে থাকার প্রয়োজন নেই। পবিত্র ও শুদ্ধ নিয়তে দৈনন্দিন কাজ-কর্মের মধ্য দিয়েই বান্দা সারাদিন আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী করতে পারে।

হযরত ছহল তশতরী (রহঃ) বলেছেন, “পেটুক লোক তিনটি অবস্থায় নিন্দনীয় ফল দেয়।” যদি সে আবেদ হয়, ইবাদাতে সে অলসতা করে। ব্যবসায়ী হলে সে বিপদ থেকে নিরাপদ থাকে না আর যদি কোন ব্যাপারে তার নিকট আসে, সে নিজ থেকে তার সুবিচার করে না।”

হুযুরে পাক (সাঃ) বলেছেন, ক্ষুধার দ্বারা বেহেশতের দরজায় খটখটি দাও। যে ব্যক্তি দৈনিক একটি রুটি আহার করে তৃপ্ত থাকে, তার অবশিষ্ট লোভ তুষ্ট থাকে। অভাব থেকে সে মুক্ত হয়। মানুষের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় না। সে দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পায় এবং আল্লাহর এবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে আখেরাতের ব্যবসার জন্য সম্পূর্ণরুপে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে।

রোজার দ্বারা আত্মদাম্ভিকতা দূর হয় এবং মন দান খয়রাতে উদ্বুদ্ধ হয়। হাদীসে আছে, মহানবী (সাঃ) বলেছেন, "সেদিন প্রত্যেকেই যার যার নিজের দানের ছায়াতলে থাকবে। যা সে ভক্ষন করে তা’তার পায়খানারুপে সঞ্চিত থাকে। তাই প্রতিদিনই উচিৎ কিছু টাকা-পয়সা ও খাদ্য মানুষকে দান করা। দানে ইহকাল ও পরকাল উভয় কালেই মান-সম্মান বৃদ্ধি পায়।

হুযুরে পাক (সাঃ) একদা এক ভূড়িওয়ালা ব্যক্তিকে দেখে তাঁর পবিত্র অঙ্গুলী দিয়ে লোকটির ভূড়ির প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, "এগুলো যদি অন্য কাজে ব্যয় করতে, তোমার পক্ষে তা উত্তম হত।"

রোযার উপকারের শেষ নেই। রোজা ও স্বল্পআহার পরকালের জন্য বহু মূল্যবান রতœ। একজন প্রবীন বুযর্গ বলেছেন, ‘ক্ষুধা পরকালের কুঞ্জী এবং বৈরাগ্যের দরজা। পক্ষান্তরে পরিতৃপ্ত আহার সংসারের কুঞ্জি ও লালসার দরজা।’

যে রোজা রাখে, সে নিজেই বোঝে রোজার কি কি গুণ ও উপকারিতা আছে। জীবন ভোগের জন্য নয়, ত্যাগের জন্য। ত্যাগের যে তৃপ্তি অনুভূত হয় ভোগ-বিলাস ও লোভ-লালসায় ডুবে থেকে তা কখনও উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

হাদীস শরীফে আছে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘রোজা রাখ, সুস্থ থাকবে।’ রোযা, ক্ষুধা এবং অল্পাহারে শরীর ও মন দুইই সুস্থ্য থাকে। আল্লাহ আমাদের সকলকে রোজা রাখার তৈফিক দান করুন। আমীন। 

প্রকাশঃ বাংলাবাজার পত্রিকা, (ইসলামী ভূবন) ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৮    
                        

No comments:

Post a Comment