It is now

Wednesday, March 6, 2013

৪. কোরবানীর গুরুত্ব ও জরুরী মাসায়িল

৪. কোরবানীর গুরুত্ব ও জরুরী মাসায়িল
 লেখক ঃ খন্দকার নাজনীন সুলতানা

ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান হলো ‘কোরবানী’। নামায, রোযার ন্যায় কোরবানীও পূর্ববর্তী নবীদের জন্য অবশ্য করনীয় ছিল। উম্মতে মুহাম্মদীর উপরও কোরবানী ওয়াজিব। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, ‘ঈদুল আজহার দিনে আল্লাহর কাছে কোরবানীই সর্বাপেক্ষা প্রিয় ও বড় ইবাদত।’

পবিত্র আল কুরআনের সূরা হজ্জ-এর ৩৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেনÑ "আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানী নির্ধারন করেছি। যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারন করে। অতএব তোমাদের আল্লাহতো একমাত্র আল্লাহ। সুতরাং তাঁরাই আজ্ঞাধীন থাক এবং বিনয়ীগনকে সুসংবাদ দাও।"
কোরবানীর পশু জবেহ করার সময় প্রথম রক্তের যে ফোঁটা পড়ে তা মাটিতে পড়ার পূর্বেই আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীসে আছেÑ "রাসুল করীম (সাঃ) বলেছেন, “কোরবানীর দিনে মানব সন্তানের কোন নেক কাজই আল্লাহর নিকট তত প্রিয় নয় যত প্রিয় কোরবানীর পশুর রক্ত প্রবাহিত করা। কোরবানীকৃত পশুগুলো তাদের শিং, পশম ও ক্ষুরসহ কিয়ামতের দিন কোরবানী দাতার পাল্লায় এনে দেয়া হবে। কোরবানীর পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর নিকট সম্মানিত স্থানে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা আনন্দ চিত্তে কোরবানী করবে।" (তিরমিযী, ইবনে মাযাহ)

প্রাপ্তবয়স্ক, সামর্থবান প্রতিটি মুসলমানের জন্য কোরবানী করা ওয়াজিব। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেনÑ“সামর্থ থাকা সত্বেও যে কোরবানী  করবে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে।" (মুসনাদে আহমদ/ ইবনে মাজা)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, “প্রিয় নবী (সাঃ) মদীনায় দশ বছর অবস্থান করেছেন, এ সময় তিনি প্রতি বছর কোরবানী করতেন।” (তিরমিযি)
মুসলমানদেরকে সহীহ নিয়তে কোরবানী করতে হবে। আল্লাহর ইচ্ছাÑ কোরবানীদাতার ঐকান্তিক নিষ্ঠা,
আন্তরিকতা ও আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যেই যেন কোরবানী  দেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর ঘোষনা হচ্ছে, “বল আমার নামায, আমার কোরবানী, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহরই জন্য।”

অন্যত্র আল্লাহ ঘোষনা করেনÑ “কোরবানীর পশুর গোশত ও রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছে না, পৌঁছে তার নিকট শুধুমাত্র তোমাদের তাকওয়া-পরহেজগারী।”
অর্থাৎ কোরবানী  হওয়া উচিৎ শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তষ্টির মানসে। পবিত্র আল কুরআনের সূরা হজ্জ এর ৩৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “কোরবানীকৃত পশুর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন। যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষনা কর। এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎ কর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দাও।”

যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখ সন্ধার মধ্যে এ তিন দিন কোরবানী করার সময়। এ তিন দিনের যে দিন ইচ্ছে সে দিনই কোরবানী করা যায়। তবে প্রথম দিন কোরবানী করা উত্তম। তারপর দ্বিতীয় দিন, তারপর তৃতীয় দিন। ঈদের নামাযের পরেই কোরবানী দেবার নিয়ম। কোরবানীর পশু নিজেদের হাতে যবেহ করা মুস্তাহাব। নিজে যবেহ করতে না পারলে অন্য নেককার ও আলেম দিয়ে যবেহ করা উত্তম। এ সময় নিজে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো। স্ত্রীলোক পর্দার রক্ষার্থে সামনে না থাকলে কোন ক্ষতি নেই। (বেহেশতী জেওর- ৩য় খন্ড)

ছয় প্রকার গৃহপালিত পশু নর-মাদী উভয়ই কোরবানী  করা যায়। যেমনঃ উট, গরু, মহিষ, দুম্বা, ভেড়া ও ছাগল। নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাব ছাড়া যার নিকট নিসাব পরিমান সম্পদ আছে অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য কিংবা তৎসম মূল্যের জিনিসপত্র অথবা নগদ টাকা বা ব্যবসার মাল। তার উপর কোরবানী করা ওয়াজিব। কোরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য সেই মাল বছরকাল স্থায়ী থাকা শর্ত নয়। নেসাব পরিমান সম্পদশালী ব্যক্তি আকিল-বালিগ ও মুকীম হওয়া আবশ্যক।

ভেড়া, দুম্বা ও ছাগল একজনের পক্ষ থেকে একটাই কোরবানী করতে হবে। আর গরু, মহিষ ও উট অনুর্দ্ধ সাতজন শরীক মিলে কোরবানী  করতে পারবে। শরীকে কোরবানীর ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় বিশেষ ভাবে লক্ষনীয়।
(১) কোরবানী  বা আকীকার সুস্পষ্ট নিয়ত করা।

(২) শরীকদারদের ভাগের টাকায় কম-বেশী না হওয়া।
(৩) কোরবানী পশুর গোশত সমানভাবে বন্টন করা।

কোরবানীর পশুর উপর আরোহন করা বা তাকে দিয়ে কোন কাজ করানো যেমন, হাল চাষ করা, পানি উঠানো, গাড়ী টানানো ইত্যাদি মাকরুহ। কেউ এরূপ করে ফেললে সেই পরিমান মজুরী সদকা হিসাবে দরিদ্রদের দিয়ে দিতে হবে। কোরবানীর পশুর দুধ দোহন করাও জায়িয নয়, যদি কেউ ভুল করে বা পশুর কষ্ট লাঘবের জন্য দুধ দোহন করে, তবে তাও সদকা হিসাবে দিয়ে দিতে হবে।

কোরবানীর গোশত তিন ভাগ করা মুস্তাহাব। নিজ ও নিজ পরিবার পরিজনের জন্য এক ভাগ, আত্মীয়-স্বজনের জন্য এক ভাগ ও ফকীর-মিসকীনদের জন্য এক ভাগ। পরিবারের লোক সংখ্যা বেশী হলে, নিজেদের জন্য পরিমানে বেশী রাখা যাবে। কিন্তু মান্নতের কোরবানীর ক্ষেত্রে সব গোশতই সদকা করা ওয়াজিব।

কোরবানীকৃত পশুর চামড়া বিক্রি না করে দান করা যাবে। আর বিক্রি করলে তার মূল্য সদকা করা ওয়াজিব।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর অতি আদরের পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে কোরবানী করেন। কিন্তু আল্লাহর অশেষ মহিমায় পুত্রের পরিবর্তে দুম্বার কোরবানী হয়। মিনার নির্জন প্রান্তরে দুই নবী কোরবানীর মাধ্যমে যে বিশাল ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, তা চির দিনের জন্য আল্লাহর দরবারে মকবুল হয়ে রইল। সকল বান্দাকে সে আদর্শে উজ্জিবিত হওয়ার মানসেই প্রতি বছর কোরবানীর নিয়ম।

হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও হযরত ইসমাঈল (আঃ) অমরত্বের পুরস্কারে পুরস্কৃত হলেন। শত শত বছর ধরে মানুষ সে ত্যাগকে  স্মরণ করছে। যুগে যুগে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে আল্লাহর জন্য নিজের সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তুর কোরবানী করা ও আত্মদানে।
মানুষের ভেতরকার পশুত্ব, সব খারাপ ও নোংরামীকে কোরবানী করাই কোরবানীর মূল উদ্দেশ্য। শুধুমাত্র প্রতীকী কোরবানী নয় আল্লাহর তরে সত্যিকারভাবে কোরবানী করে আমরা যেন হয়ে উঠি নিস্পাপ ও আদর্শবান্দা রুপে। আমীন। 

প্রকাশঃ পাক্ষিক ইতিকথা, ৫ডিসেম্বর, ২০০৮।

2 comments: